মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৩৯
ভীমের কির্মীর বধ, দ্রৌপদীর ক্ষোভ ও কৃষ্ণের শাল্ব বধ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
ভীমের কির্মীর বধ, দ্রৌপদীর ক্ষোভ ও কৃষ্ণের শাল্ব বধ
ভীম কির্মীর রাক্ষসকে কি কোরে বধ করেছেন ধৃতরাষ্ট্র জানতে চাইলে, মৈত্রেয় উত্তর দিলেন, আমি আর কিছু বলব না, আমি চলে গেলে বিদুরের কাছে শুনবেন।
মৈত্রেয় চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, ভীম কি ভাবে কির্মীর রাক্ষকে বধ করলো তুমি আমাকে সেই বৃত্তান্ত বলো। বিদুর বললেন, যুধিষ্ঠিরের নিকট যে ব্রাহ্মণরা এসেছিলেন, তাদের কাছে যা শুনেছি তাই বলছি - পাণ্ডবরা এখান থেকে যাত্রা কোরে কাম্যকবনে পৌঁছেছিলেন। রাত্রিকালে নরখাদক রাক্ষসেরা সেখানে ঘুরে বেড়ায়। তাদের ভয়ে কেউই সেই বনের নিকটে যান না। পাণ্ডবরা সেই বনে প্রবেশ করলে এক ভীষণ বিশালদেহী রাক্ষস জ্বলন্ত কাঠ হাতে নিয়ে তাঁদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। তার হুঙ্কারে বনের সমস্ত পশু-পাখী ভয়ে পালাতে লাগল। দ্রৌপদী ভয়ে চোখ বুজলেন, পঞ্চপান্ডব তাঁকে ধরে রইলেন। পুরোহিত ধৌম্য যথাবিধি রক্ষামন্ত্র পাঠ কোরে রাক্ষসের মায়া বিনষ্ট করলেন। যুধিষ্ঠির রাক্ষসকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে, কি চাও? রাক্ষস বললো, আমি কির্মীর, বক রাক্ষসের ভাই, আমি তোমাদের যুদ্ধে পরাজিত করে ভক্ষণ করবো। যুধিষ্ঠির নিজেদের পরিচয় দিলে, কির্মীর বললো ভাগ্যক্রমে আমার ভাইয়ের হত্যাকারী ভীমের দেখা পেয়েছি। ভীম ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে আমার ভাইকে মেরেছে, আমার প্রিয় বন্ধু হিড়িম্বকে বধ করে তার ভগিনীকে বিবাহ করেছে। আজ ভীমকে ভক্ষণ করে ভীমের রক্তে আমার ভাইয়ের তর্পণ করব, হিড়িম্বকে বধ করার প্রতিশোধ নেবো।
কির্মীরের কথা শুনে ভীম একটি বিশাল গাছ উপড়ে নিলেন। ভীম গাছ দিয়ে রাক্ষসের মাথায় জোরে আঘাত করলেন, কির্মীর রাক্ষসও জ্বলন্ত কাঠ ভীমের দিকে ছুড়ে মারলে, ভীম বাম পায়ের আঘাতে সেই কাঠ রাক্ষসের দিকেই ছুঁড়ে দিলেন। তারপর ভীম ও কির্মীর বলবান ষাঁড়ের মতো পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। ভীমের ভয়ঙ্কর আঘাতে কির্মীর ভূতলে পড়লে, ভীম তাকে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেললেন। এরপর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী ও ভাইদের সঙ্গে সেখানেই বাস করছেন। আমি তাঁদের কাছে যাবার সময় কাম্যক বনের পথে সেই রাক্ষসের মৃতদেহ দেখেছি।
পাণ্ডবগণের বনবাসের সংবাদ পেয়ে ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয় রাজারা তাদের দেখতে এলেন। পাঞ্চালরাজের পুত্রগণ, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু এবং কেকয় রাজ্যের রাজপুত্রগণও এলেন। সেই ক্ষত্রিয়বীরগণ কৃষ্ণকে সামনে রেখে যুধিষ্ঠিরের চতুর্দিকে উপবেশন করলেন।
বিষন্নমনে যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে কৃষ্ণ বললেন, যুদ্ধভূমি দুরাত্মা দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি আর দুঃশাসনের রক্তে লাল হবে। তাদের নিহত এবং দলের সকলকে পরাজিত করে আমরা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করবো। অনিষ্টকারী প্রবঞ্চককে হত্যা করাই ধর্ম।
পাশা খেলায় পাণ্ডবগণের পরাজয়ে কৃষ্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, তিনি যেন ভয়ঙ্কর তেজে ত্রিভুবন জ্বালিয়ে ছারখার কোরে দিতে উদ্যত হলেন। অর্জুন তাঁকে শান্ত কোরে তাঁর পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করিয়ে বললেন - কৃষ্ণ, তুমি পুরাকালে গন্ধমাদন পর্বতে যত্রসায়ংগৃহ মুনি হয়ে দশ হাজার বছর ভ্রমণ করেছিলে। আমি ব্যাসদেবের কাছে শুনেছি, তুমি বহু বছর পুষ্কর তীর্থে, বদরিকায়, সরস্বতী নদীর তীরে ও প্রভাস তীর্থে কষ্টকর সাধনা করেছিলে। তুমি সর্বভূতের আদি ও অন্ত। তুমি সমস্ত দৈত্য-দানব বধ করে ইন্দ্রকে স্বর্গের অধীশ্বর করেছিলে। তুমিই নারায়ণ, হরি, ব্রহ্মা, সূর্য, চন্দ্র, কাল, আকাশ, পৃথিবী সবকিছু। তুমি বামনরূপে তিন পদক্ষেপে স্বর্গ, আকাশ ও মর্ত্য অধিকার করেছিলে। তুমি নিসুন্দ, নরকাসুর, শিশুপাল, জরাসন্ধ, শৈব্য, শতধন্বা প্রভৃতিকে জয় করেছ, রুক্মীকে পরাস্ত করে ভীষ্মকের কন্যা রুক্সিণীকে বিবাহ করেছ। ইন্দ্রদ্যুম্ন, কসেরুমান ও শাল্বকে বধ করেছ। তুমি দ্বারকা নগরীকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেবে। তোমার মধ্যে ক্রোধ, দ্বেষ, অসত্য, নৃশংসতা, কুটিলতা নেই। ব্রহ্মা তোমার নাভিপদ্ম থেকে উৎপন্ন, তুমি মধু ও কৈটভকে হত্যা করেছ, মহাদেব তোমার ললাট থেকে জন্মেছেন।
কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তুমি যেমন আমার, আমিও তেমন তোমার। যা আমার তাই তোমার, যে তোমাকে হিংসা করে সে আমাকেও হিংসা করে, যে তোমার অনুগত সে আমারও অনুগত। তুমি নর আর আমি নারায়ণ ঋষি ছিলাম, আমরা এখন নরলোকে এসেছি।
দ্রৌপদী কৃষ্ণকে বললেন, বেদব্যাস বলেছেন তুমি দেবগণেরও ঈশ্বর। তুমি সর্বভূতের ঈশ্বর, সেজন্য আমি তোমাকে আমার দুঃখ জানাচ্ছি। আমি পাণ্ডবগণের স্ত্রী, তোমার সখী, ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন। দুঃশাসন কেন আমাকে কুরুসভায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল? আমার একমাত্র বস্ত্র রক্তাক্ত, আমি লজ্জায় কাঁপছি, আমাকে দেখে পাপাত্মা দুর্যোধনেরা হেসে উঠল। পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র, পাঞ্চালগণ ও বৃষ্ণিগণ জীবিত থাকতে তারা আমাকে দাসীরূপে ভোগ করতে চেয়েছিল। ধিক পাণ্ডবগণ, ধিক ভীমের শক্তি, ধিক অর্জুনের গাণ্ডীব! তাদের ধর্মপত্নীকে যখন নীচ ব্যক্তিরা নিগ্রহ করছিল তখন তারা নীরবে দেখছিলেন। স্বামী দুর্বল হলেও স্ত্রীকে রক্ষা করে, এই সনাতন ধর্ম। পাণ্ডবরা শরণাপন্নকে ত্যাগ করে না, কিন্তু আমাকে রক্ষা করেননি। কৃষ্ণ, আমি বহু কষ্ট পেয়ে মাতা কুন্তীকে ছেড়ে পুরোহিত ধৌম্যের আশ্রয়ে বাস করছি। আমি যে নির্যাতন ভোগ করেছি তা এই পাণ্ডব বীরগণ কেন উপেক্ষা করছেন? দেবতার বিধানে মহৎ কুলে আমার জন্ম, আমি পাণ্ডবদের স্ত্রী, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ, তথাপি পঞ্চপাণ্ডবের সামনেই দুঃশাসন আমার কেশ ধরে টেনে এনেছিল।
দ্রৌপদী হাত দিয়ে মুখ ঢেকে অভিমানে কোরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে কৃষ্ণ, আমার পতি নেই, পুত্র নেই, বান্ধব নেই, ভাই নেই, পিতা নেই, তুমিও নেই। দুরাত্মারা আমাকে নির্যাতন করেছে, তোমরা সবাই তা উপেক্ষা করেছ। কর্ণ আমাকে যে উপহাস করেছিল, সেই দুঃখ আমার দূর হচ্ছে না। আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আত্মীয়তা আছে, তোমার যশ ও গৌরব আছে, তুমি আমার সখা ও প্রভু, এই কারণে আমাকে রক্ষা করা তোমার উচিত।
কৃষ্ণ বললেন, তুমি যাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ তারা অর্জুনের বাণে মরবে, তা দেখে তাদের স্ত্রীরা কাঁদবে। পাণ্ডবদের জন্য যা কিছু সম্ভব তা আমি করবো। আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করছি, তুমি রাজগণের রানী হবে। আমার প্রতিজ্ঞা ব্যর্থ হবে না।
দ্রৌপদী অর্জুনের দিকে তাকালেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, তুমি কেঁদো না, কৃষ্ণ যা বললেন তার অন্যথা হবে না। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, আমি দ্রোণকে বধ করবো, শিখন্ডী ভীষ্মকে বধ করবে, ভীম দুর্যোধনকে ও তার ভাইদেরকে এবং অর্জুন কর্ণকে বধ করবেন। বলরাম আর কৃষ্ণকে সহায় রূপে পেলে আমরা ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধেও জয়ী হবো। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমি যদি দ্বারকায় থাকতাম তবে আপনাদের এই কষ্ট হোতো না। আমাকে না ডাকলেও আমি কুরুসভায় যেতাম এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র, প্রভৃতি কে বুঝিয়ে পাশা খেলা বন্ধ করতাম। ধৃতরাষ্ট্র যদি না শুনতেন তবে তাকে সবলে বাধ্য করতাম, শকুনিকে বধ করতাম। আমি দ্বারকায় ফিরে এসে সাত্যকির কাছে আপনাদের বিপদের কথা শুনে উদ্বিগ্ন হোয়ে দেখতে এসেছি।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, কৃষ্ণ তুমি দ্বারকা ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলে? কৃষ্ণ বললেন, আমি শাল্ব রাজার সৌভনগর বিনষ্ট করতে গিয়েছিলাম। আপনার রাজসূয় যজ্ঞে আমি শিশুপালকে বধ করেছি শুনে শাল্ব ক্রুদ্ধ হয়ে দ্বারকাপুরী আক্রমণ করেন। তিনি তাঁর সৌভবিমানে ব্যূহ রচনা করে আকাশে অবস্থান করছিলেন। এই বৃহৎ বিমানই তাঁর নগর। যাদববীরগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দ্বারকাপুরী সর্বপ্রকারে সুরক্ষিত করলেন। উগ্রসেন, উদ্ধব প্রভৃতি ঘোষণা করলেন, কেউ সুরাপান করবে না। সমস্ত সেতু ভেঙে দেওয়া হল এবং নৌকার যাতায়াত নিষিদ্ধ হল। সৈন্যদের বেতন খাদ্য ও পরিচ্ছদ দিয়ে সন্তুষ্ট করা হোলো। শাল্বের চতুরঙ্গিণী সেনা সর্বদিক ঘিরে দ্বারকা অবরুদ্ধ করলে। তখন চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব প্রভৃতি বীরগণ রথে আরোহণ কোরে শাল্বের সম্মুখীন হলেন। শাম্ব শাল্বের সেনাপতি ক্ষেমবৃদ্ধির সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। ক্ষেমবৃদ্ধি আহত হয়ে পালিয়ে গেলে বেগবান নামে এক দৈত্য শাম্বকে আক্রমণ করলো, কিন্তু সে শাম্বের গদাঘাতে নিহত হল। বিবিন্ধ্য নামে এক মহাবল দানবকে চারুদেষ্ণ বধ করলেন।
প্রদ্যুম্ন শাল্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি শরাঘাতে মুর্ছিত হয়ে পড়ে গেলে সারথি তাকে দ্রুতগামী রথে যুদ্ধভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। জ্ঞান ফিরে পেয়ে প্রদ্যুম্ন বললেন, তুমি রথ ফিরিয়ে নাও, যুদ্ধ থেকে পালানো বৃষ্ণিকুলের রীতি নয়। আমাকে পিছনে হঠতে দেখলে কৃষ্ণ, বলরাম, সাত্যকি প্রভৃতি কি বলবেন? কৃষ্ণ আমাকে দ্বারকা রক্ষার ভার দিয়ে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে গেছেন, তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। প্রদ্যুম্ন আবার রণস্থলে গেলেন এবং শাল্বকে শরাঘাতে ভূপাতিত করে এক ভয়ংকর শর ধনুতে সন্ধান করলেন। তখন ইন্দ্রাদি দেবগণের আদেশে নারদ ও পবনদেব এসে প্রদ্যুম্নকে বললেন, শাল্বরাজ তোমার বধ্য নন, বিধাতার ইচ্ছায় কৃষ্ণের হাতে এঁর মৃত্যু হবে। প্রদ্যুম্ন নিবৃত্ত হলেন, শাল্বও দ্বারকা ত্যাগ করে সৌভবিমানে আকাশে উঠলেন।
মহারাজা যুধিষ্ঠির, আপনার রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হলে আমি দ্বারকায় ফিরে এসে দেখলাম যে শাল্বের আক্রমণে নগরী বিধ্বস্ত হয়েছে। উগ্রসেন, বসুদেব, প্রভৃতিকে আশ্বস্ত করে চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে আমি শাল্বের অনুসরণ করলাম। শাল্ব সমুদ্রের উপরে আকাশে অবস্থান করছিলেন। আমার নিক্ষিপ্ত বাণ তার সৌভবিমান স্পর্শ করতে পারল না। তখন আমি অসংখ্য শর নিক্ষেপ করলাম, তার আঘাতে সৌভবিমানের মধ্যে যোদ্ধারা আহত ও নিহত হোয়ে সমুদ্রে পড়ে গেলো। তখন শাল্ব মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করলে আমি প্রজ্ঞাস্ত্র দিয়ে তাঁর মায়া অপসারণ করলাম।
এই সময়ে উগ্রসেনের এক পরিচারক এসে আমাকে জানাল যে, শাল্ব দ্বারকায় গিয়ে তোমার পিতা বসুদেবকে বধ করেছে, আর যুদ্ধের প্রয়োজন নেই, তুমি ফিরে এস। এই সংবাদ শুনে আমি শোকে অভিভুত হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলাম। সহসা দেখলাম, আমার পিতা সৌভবিমান থেকে সমুদ্রে পতিত হচ্ছেন। কিছুক্ষণ অচেতন থাকার পর চেতনা ফিরে পেয়ে দেখলাম সৌভবিমান নেই, শাল্ব নেই, আমার পিতাও নেই। তখন বুঝলাম সমস্তই শাল্বের মায়া। দানবগণ অদৃশ্য বিমান থেকে পাথর ছুঁড়তে লাগল। অবশেষে আমি কালান্তক যমের তুল্য সুদর্শন চক্র কে নির্দেশ দিয়ে বললাম, তুমি সৌভবিমান এবং তার অধিবাসী শত্রুগণকে বিনষ্ট করো। তখন সুদর্শন চক্র আকাশে উঠে সৌভবিমানকে টুকরো টুকরো করলো। সুদর্শন চক্র আমার হাতে ফিরে এলে তাকে আবার আদেশ দিলাম, শাল্বকে বিনাশ করো। সুদর্শন চক্রের আঘাতে শাল্ব দ্বিখন্ডিত হলেন, তাঁর অনুচর দানবগণ তাই দেখে আতঙ্কিত হোয়ে পালিয়ে গেল।
শাল্ববধের বিবরণ শেষ করে কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আমি পাশা খেলার সভায় কেন যেতে পারিনি তার কারণ বললাম। আমি গেলে পাশা খেলা হোতো না। তারপর কৃষ্ণ পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর কাছে বিদায় নিয়ে সুভদ্রা ও অভিমন্যুর সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীর পুত্রদের নিয়ে পাঞ্চালরাজ্যে এবং ধৃষ্টকেতু নিজের ভগিনীর সঙ্গে চেদিরাজ্যে ফিরে গেলেন, কৈকেয়গণও নিজেদের রাজ্যে প্রস্থান করলেন।
______________
(ক্রমশ)