Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 40

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪০

দেবতাদের কাছ অর্জুনের বিবিধ দিব্যাস্ত্র লাভ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

দেবতাদের কাছ অর্জুনের বিবিধ দিব্যাস্ত্র লাভ

পাণ্ডবদের বনবাসকালে এক দিন বেদব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে অন্তরালে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমাকে আমি প্রতিস্মৃতি নামে একটি মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি, তার প্রভাবে অর্জুন দেবতাদের থেকে অস্ত্রলাভ করবে। অস্ত্রলাভ করবার জন্য সে ইন্দ্র, রুদ্র, বরুণ, কুবের ও যমের নিকট যাক। তোমরাও এই বন ত্যাগ করে অন্য বনে যাও, এক স্থানে দীর্ঘকাল থাকা তপস্বীদের কাছে উদ্বেগজনক, তাতে গাছপালা ও পশুদের ক্ষতি হয়। এই বলে বেদব্যাস চলে গেলেন। যুধিষ্ঠির প্রতিস্মৃতি মন্ত্র লাভ করে অমাত্য ও অনুচরদের সঙ্গে কাম্যকবনে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।

কিছুকাল পরে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ ও অশ্বখামা - এঁরা সমগ্র ধনুর্বিদ্যায় বিশারদ, দুর্যোধন এঁদের সম্মানিত ও সন্তষ্ট করেছে। সমস্ত পৃথিবীই এখন তার অধিনে এসেছে। তুমি আমাদের প্রিয়, তোমার উপরেই আমরা নির্ভর করি। বৎস, আমি বেদব্যাসের নিকট একটি প্রতিস্মৃতি নামে একটি মন্ত্রলাভ করেছি, তুমি তা শিখে নিয়ে উত্তর দিকে গিয়ে কঠোর তপস্যা কর। সমস্ত দিব্যাস্ত্র ইন্দ্রের কাছে আছে, তুমি তাঁর শরণাপন্ন হয়ে সেই সকল অস্ত্র লাভ করো।

য়ুধিষ্ঠিরের কথা শুনে অর্জুন সশস্ত্র হয়ে যাত্রার উদ্যোগ করলেন। দ্রৌপদী তাঁকে বললেন, পার্থ, আমাদের সুখ দুঃখ জীবন মরণ রাজ্য ঐশ্চর্য সবই তোমার উপর নির্ভর করছে। তোমার মঙ্গল হোক, বলবানদের সঙ্গে তুমি বিরোধ করো না। জয়লাভের জন্য যাত্রা করো, বিধাতা তোমাকে কুশলে ও নীরোগ রাখুন।

অর্জুন হিমালয় ও গন্ধমাদন পার হয়ে ইন্দ্রকীল পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি আকাশবাণী শুনলেন, তিষ্ঠ। অর্জুন দেখলেন, পিঙ্গলবর্ণ জটাধারী এক তপস্বী একটি বিশাল গাছের নীচে বসে আছেন। তিনি বললেন, বৎস, তুমি কে? অস্ত্রধারী হয়ে এখানে কেন এসেছ? এই শান্ত তপোবনে অস্ত্রের প্রয়োজন নেই, তুমি ধনু ত্যাগ করো, তপস্যার প্রভাবে তুমি পরমগতি পেয়েছ। অর্জুনকে অবিচলিত দেখে তপস্বী বললেন, আমি ইন্দ্র, তোমার মঙ্গল হোক, তুমি অভীষ্ট স্বর্গ প্রার্থনা করো। অর্জুন হাতজোড় কোরে বললেন, ভগবান, আমাকে সর্ববিধ অস্ত্র দান করুন, আর কিছুই আমি চাই না। যদি আমার ভাইদের বনে ফেলে রাখি এবং শক্রর উপর প্রতিশোধ নিতে না পারি তবে আমার অকীর্তি চিরস্থায়ী হবে। তখন ইন্দ্র বললেন, বৎস, তুমি যখন শূলপাণি শিবের দর্শন পাবে তখন সমস্ত দিব্য অস্ত্র তোমাকে দেবো। এই বলে ইন্দ্র অদৃশ্য হলেন।

ইন্দ্র অদৃশ্য হওয়ার পর অর্জুন চলতে চলতে একদিন এক ঘোর বনে উপস্থিত হয়ে আকাশে শঙ্খ ও দুন্দুভির ধ্বনি শুনতে পেলেন। তিনি সেখানে কঠোর তপস্যায় নিরত হোলে, মহর্ষিগণ মহাদেবকে জানালেন। মহাদেব কিরাতের বেশ ধারণ করে পিনাকহস্তে অর্জুনকে দর্শন দিলেন। কিরাতিনীর বেশে দেবী উমা, তার সহচরীবৃন্দ এবং ভূতগণও মহাদেবের সঙ্গে গমন করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত বন নিঃশব্দ হল, ঝর্ণার শব্দ ও পাখীর ডাকও থেমে গেল। সেই সময়ে মূক নামে এক দানব বরাহের রূপ ধারণ কোরে অর্জুনের দিকে ধেয়ে এলো। অর্জুন বরাহকে বাণ দিয়ে মারতে গেলে কিরাতবেশী মহাদেব বললেন, এই বরাহকে মারবার ইচ্ছা আমিই আগে করেছি। অর্জুন বারণ শুনলেন না, তিনি ও কিরাত একই সময়ে বাণ ছুঁড়লেন, দুই বাণ একসঙ্গে বরাহের দেহে বিদ্ধ হল। মূক দানব ভীষণ চীৎকার কোরে মরে গেল। অর্জুন কিরাতকে সহাস্যে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? এই বনে স্ত্রীদের নিয়ে বিচরণ করছ কেন? আমার শিকার এই বরাহকে কেন তুমি বাণবিদ্ধ করলে? পর্বতবাসী, তুমি মৃগয়ার নিয়ম লঙ্ঘন করেছ সেজন্য তোমাকে বধ করবো। কিরাত হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, বীর, আমরা এই বনেই থাকি তুমি ভয় পেয়ো না। এই জনহীন দেশে কেন এসেছ? অর্জুন বললেন, মন্দবুদ্ধি তুমি বলদর্পে নিজের দোষ মানছ না, আমার হাতে তোমার নিস্তার নেই।

অর্জুন বাণবর্ষণ করতে লাগলেন, কিরাতরূপী পিনাকপাণি শংকর অক্ষত শরীরে পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে অর্জুন বললেন, সাধু সাধু। তার অক্ষয় তূণীরের সমস্ত বাণ নিঃশেষ হোলো, তখন তিনি ধনুর্গুণ দিয়ে কিরাতকে আকর্ষণ করে মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন, কিরাত ধনু কেড়ে নিলেন। অর্জুন তাঁর মস্তকে খড়্গ দিযে আঘাত করলেন, খড়্গ ছিটকে গেল। অর্জুন বৃক্ষ আর পাথর দিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন, তাও বৃথা হোলো। তখন দুজনে ঘোর মুষ্টিযুদ্ধ হতে লাগল। কিরাতের বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে অর্জুনের শ্বাসরোধ হোলো, তিনি অচেতন হোয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে চৈতন্য পেয়ে তিনি মহাদেবের মূর্তি গড়ে পূজা করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, তার নিবেদিত মালা কিরাতের গলায় শোভা পাচ্ছে। তখন তিনি কিরাতরূপী মহাদেবের চরণে পতিত হয়ে স্তব করতে লাগলেন।

মহাদেব প্রীত হয়ে অর্জুনকে আলিঙ্গন করে বললেন, পার্থ, তুমি পূর্বজন্মে বদরিকাশ্রমে নারায়ণের সহচর নর হয়ে অযুত বৎসর তপস্যা করেছিলে, তোমরা নিজ তেজে জগৎ রক্ষা করছ। তুমি বর চাও। অর্জুন বললেন, হে মহাদেব, ব্রহ্মশির নামে আপনার যে পাশুপত অস্ত্র আছে তাই আমাকে দিন, কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধকালে আমি তা প্রয়োগ করব। মহাদেব মূর্তিমান কৃতান্তের তুল্য সেই অস্ত্র অর্জুনকে দান করে তার প্রয়োগ ও প্রত্যাহারের বিধি শিখিয়ে দিলেন। তার পর অর্জুনের শরীর স্পর্শ করে সকল ব্যথা দূর করে বললেন, এখন তুমি স্বর্গে যাও। এই বলে তিনি উমার সঙ্গে প্রস্থান করলেন।

তখন বরুণ, কুবের, যম, এবং ইন্দ্র অর্জুনের নিকট আবির্ভূত হলেন। যম তাঁর দণ্ড, বরুণ তাঁর পাশ এবং কুবের অন্তর্ধান নামক অস্ত্র দান করলেন। ইন্দ্র বললেন, অর্জুন, উদ্দেশ্য সফল করার জন্য দেবলোকে যেতে হবে সেখানেই তোমাকে সমস্ত দিব্যাস্ত্র দান করবো। তার পর দেবতারা চলে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)