Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 42

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪৩

পাণ্ডবদের তীর্থযাত্রা ও মহর্ষি লোমশ বর্ণিত ইল্বল, বাতাপি এবং অগস্ত্যের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

পাণ্ডবদের তীর্থযাত্রা ও মহর্ষি লোমশ বর্ণিত ইল্বল, বাতাপি এবং অগস্ত্যের কাহিনি

অর্জুনের দিব্যাস্ত্র সংগ্রহের নিমিত্ত ইন্দ্রলোকে অবস্থান করার জন্য তার অনুপস্থিতিতে বিষগ্ন হয়ে পাণ্ডবগণ কাম্যকবন ত্যাগ করে অন্যত্র যাবার ইচ্ছা করলেন। তখন একদিন দেবর্ষি নারদ ও ব্রহ্মর্ষি লোমশ এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমরা ইন্দ্রলোক থেকে আসছি, অর্জুন মহাদেবের নিকট ব্রহ্মশির নামক অস্ত্র লাভ করেছেন, যম কুবের বরুণ ইন্দ্রও তাকে বিবিধ দিব্যাস্ত্র দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাবসুর পুত্র চিত্রসেনের নিকট নৃত্য গীত বাদ্য ও সামগান যথাবিধি শিখেছেন। দেবরাজ ইন্দ্র তোমাকে এই কথা বলতে বলছেন – “অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা শেষ হয়েছে, তিনি শীঘ্রই তোমাদের কাছে ফিরে যাবেন। আমি জানি যে সূর্যপুত্র কর্ণ সত্য-প্রতিজ্ঞ, মহাবল, মহাধনুর্ধর, কিন্তু তিনি এখন অর্জুনের ষোলো ভাগের এক ভাগের তুল্যও নন। কর্ণের যে সহজাত কবচকে তোমরা ভয় করো, তাও আমি হরণ করবো”। তার পর নারদ বললেন তোমাদের যে তীর্থযাত্রার অভিলাষ হয়েছে তার সম্বন্ধে এই ব্রহ্মর্ষি লোমশই তোমাকে উপদেশ দেবেন। লোমশ বললেন, ইন্দ্র আর অর্জুনের অনুরোধে আমি তোমার সঙ্গে তীর্থভ্রমণ করব এবং সকল ভয় থেকে তোমাদের রক্ষা করব।

তার পর পাণ্ডবগণ কাম্যক বন ত্যাগ কোরে নৈমিষারণ্য প্রয়াগ প্রভৃতি তীর্থ দর্শন করে অগস্ত্যের আশ্রম মণিমতী পুরীতে এলেন। লোমশ বললেন, পুরাকালে এখানে ইল্বল নামে এক দৈত্য বাস করত, তার কনিষ্ঠ ভাইয়ের নাম বাতাপি। দেবতার বরে ইল্বল আর বাতাপি নানা মায়া জানত এবং বাতাপি মায়াবলে নানা জন্তুর রূপ ধারণ করলে ইল্বল তাকে কেটে তার মাংস রান্না কোরে একাধিক ব্যক্তিকে খাওয়ানোর পরে ইল্বল বাতাপির নাম ধরে ডাকলে বাতাপি সকলের পেট ফাটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসত, যার ফলে যারা তার মাংস খেয়েছিল তারা মারা যেত। একদিন ইল্বল এক তপস্বী ব্রাহ্মণকে বললে, আমাকে একটি ইন্দ্রের মতো পুত্র দিন। ব্রাহ্মণ তার প্রার্থনা পূর্ণ করলেন না। এর ফলে ইল্বল ভীষণ ক্রুদ্ধ হযে মায়াবলে বাতাপিকে ছাগল বা ভেড়ায় রূপান্তরিত করে তার মাংস বেঁধে ব্রাহ্মণভোজন করাতে লাগল। ভোজনের পর ইল্বল তার ভ্রাতাকে উচ্চস্বরে ডাকত, তখন ব্রাহ্মণদের পেট ফাটিয়ে দিয়ে বাতাপি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসত। দুরাত্মা ইল্বল এইরূপে বহু ব্রাহ্মণ হত্যা করলো।

এই সময়ে অগস্ত্য মুনি একদিন দেখলেন, একটি গর্তের মধ্যে তার পিতৃপুরুষগণ অধোমুখে ঝুলছেন। অগস্ত্যের প্রশ্নের উত্তরে তারা বললেন, আমাদের বংশলোপের আশঙ্কায় আমরা এই অবস্থায় আছি। যদি তুমি সৎপুত্রের জন্ম দিতে পারো তবে আমরা নরক থেকে মুক্ত হবো। অগস্ত্য বললেন, পিতৃগণ, নিশ্চিন্ত হন, আমি আপনাদের ইচ্ছা পূর্ণ করবো।

অগস্ত্য নিজের যোগ্য স্ত্রী খুঁজে পেলেন না। তখন তিনি সর্ব প্রাণীর শ্রেষ্ঠ অঙ্গের মিশ্রণে এক সুন্দরী স্ত্রীর কল্পনা করলেন। সেই সময়ে বিদর্ভ দেশের রাজা সন্তানের জন্য তপস্যা করছিলেন, তাঁর মহিষীর গর্ভ থেকে অগস্ত্যের সেই কল্পিত স্ত্রী ভূমিষ্ঠ হলেন। অত্যন্ত সুন্দরী সেই কন্যার নাম রাখা হল লোপামুদ্রা। লোপামুদ্রা বিবাহযোগ্যা হলে অগস্ত্য বিদর্ভরাজকে বললেন, আপনার কন্যা আমাকে দিন। অগস্ত্যকে কন্যাদান করতে রাজার ইচ্ছা হোলো না, আবার অভিশাপের ভয়ে প্রত্যাখ্যান করতেও তিনি পারলেন না। রাজরানীও নিজের মত বললেন না। তখন লোপামুদ্রা বললেন, আমার জন্য দুঃখ করবেন না, অগস্ত্যের সাথে আমাকে বিবাহ দিন। তখন রাজা অগস্ত্যকে যথাবিধি কন্যা সম্প্রদান করলেন।

বিবাহের পর অগস্ত্য তাঁর পত্নীকে বললেন, তোমার মহার্ঘ বসন ও অলঙ্কার ত্যাগ করো। লোপামুদ্রা মৃগচর্ম ধারণ করে পতির সঙ্গে ব্রতচারিণী হলেন। অনেক দিন গঙ্গাতীরে কঠোর তপস্যার পর, একদিন অগস্ত্য পত্নীর নিকট সহবাস প্রার্থনা করলেন। লোপামুদ্রা কৃতাঞ্জলি হয়ে লজ্জিতভাবে বললেন, পিতার প্রাসাদে আমার যেমন শয্যা ছিল সেইরূপ শয্যায় আমাদের মিলন হোক। আপনি মালা ও অলঙ্কার ধারণ করুন, আমিও দিব্য আভরণে সজ্জিত হই। আমি মৃগচর্ম আর কাষায় বস্ত্র পরে আপনার কাছে যাবো না, এই পোশাক অপবিত্র করা উচিত নয়। অগস্ত্য বললেন, কল্যাণী, তোমার পিতার যে ধন আছে তা আমার নেই। আমার তপস্যার যাতে ক্ষতি না হয় এমন উপায়ে আমি ধন আহরণ করতে যাচ্ছি।

তারপর শ্রুতর্বা রাজার কাছে এসে অগস্ত্য বললেন, আমি ধন চাই, অন্যের ক্ষতি না করে আমাকে যথা সম্ভব ধন দিন। রাজা বললেন, আমার যত আয় তত ব্যয়। তাই শুনে এই রাজার কাছে ধন নিলে অপরের কষ্ট হবে এই বুঝে অগস্ত্য তাকে সঙ্গে নিয়ে একে একে ব্রধশ্ব ও সদস্যু রাজার কাছে গেলেন। তারা জানালেন যে তাদেরও আয়-ব্যয় সমান, উদ্বৃত্ত কিছু থাকে না। তার পর রাজারা পরামর্শ করে বললেন, ইল্বল দানব সর্বাপেক্ষা ধনী, চলুন আমরা তার কাছে যাই।

অগস্ত্য ও তার সঙ্গী তিন রাজা ইল্বলের কাছে গেলে ইল্বল তাদেরকে সসম্মানে গ্রহণ করলো। রাজারা ব্যাকুল হয়ে দেখলেন, বাতাপি ভেড়া হয়ে গেল আর ইল্বল তাকে কেটে অতিথিসেবার জন্য তার মাংস রান্না করলো। অগস্ত্য বললেন, আপনারা বিষণ্ণ হবেন না, আমিই এই দানবকে খাবো। তিনি প্রধান আসনে বসলে, ইল্বল তাঁকে সহাস্যে মাংস পরিবেশন করলো। অগস্ত্য সমস্ত মাংস খেয়ে ফেললে ইন্বল তার ভাইকে ডাকতে লাগল। তখন ভীষণ গর্জন করে মহাত্মা অগস্ত্যের পায়ু থেকে বায়ু নির্গত হোলো। ইল্বল বার বার বললো, বাতাপি, বেরিয়ে এসো। অগস্ত্য হেসে বললেন, কি করে বেরিয়ে আসবে, আমি তাকে হজম কোরে ফেলেছি।

ইল্বল বিষাদগ্রস্ত হয়ে হাতজোড় কোরে বললো, আপনারা কি চান বলুন। অগস্ত্য বললেন, আমরা জানি যে তুমি মহাধনী। অন্যের ক্ষতি না করে আমাদের যথাশক্তি ধন দাও। ইল্বল বললো, আমি যা যা দান করতে চাই তা যদি বলতে পারেন তবেই দেবো। অগস্ত্য বললেন, তুমি এই রাজাদের প্রত্যেককে দশ হাজার গরু আর দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং আমাকে তার দ্বিগুণ দিতে চাও, তা ছাড়া একটি স্বর্ণরথ ও দুটি ঘোড়া আমাকে দিতে ইচ্ছা করেছ। ইল্বল দুঃখিতমনে এই সকল ধন এবং তারও অধিক দান করলো। তখন সমস্ত ধন নিয়ে অগস্ত্য তার আশ্রমে এলেন, রাজারাও বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

লোপামুদ্রাকে তার অভীষ্ট শয্যা ও বসনভূষণাদি দিয়ে অগস্ত্য বললেন, তুমি কি চাও, সহস্র পুত্র, শত পুত্র, দশ পুত্র, না সহস্র পুত্রের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এক পুত্র ? লোপামুদ্রা এক পুত্র চাইলেন। তিনি অগস্ত্যের ঔরসে গর্ভবতী হোয়ে সাত মাস পরে দৃঢ়স্যু নামে এক পুত্র প্রসব করলেন। এই পুত্র মহাকবি, মহাতপা এবং বেদাদি শাস্ত্রে অভিজ্ঞ হয়েছিলেন। এর অন্য নাম ইধ্নবাহ।

কাহিনি শেষ করে লোমশ বললেন, যুধিষ্ঠির, অগস্ত্য এইরূপে প্রহাদ-বংশজাত বাতাপিকে বিনষ্ট করেছিলেন। এই তাঁর আশ্রম আর এই পুণ্যসলিলা ভাগীরথী। তোমরা এই নদীতে স্নান করো।

তার পর পাণ্ডবগণ ভৃগুতীর্থে এলে লোমশ বললেন, পুরাকালে রামরূপে বিষ্ণু পরশুরামের তেজ হরণ করেছিলেন। পরশুরাম ভীত ও লজ্জিত হোয়ে মহেন্দ্র পর্বতে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। এক বৎসর পরে পিতৃগণ তাকে নিস্তেজ গর্বহীন ও দুঃখিত দেখে বললেন, পুত্র, বিষ্ণুর নিকটে তোমার অহঙ্কার প্রকাশ করা উচিত হয়নি। তুমি দীপ্তোদ তীর্থে যাও, সেখানে সত্যযুগে তোমার প্রপিতামহ ভৃগু তপস্যা করেছিলেন। সেই তীর্থে পবিত্র বধূসর নদীতে স্নান করলে তোমার পূর্বের তেজ ফিরে পাবে। পিতৃগণের উপদেশ অনুসারে পরশুরাম এই ভৃগুতীর্থে স্নান করে তার পূর্বতেজ লাভ করেছিলেন।

______________

(ক্রমশ)