Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 41

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪২

মহর্ষি বৃহদশ্ব কর্তৃক নল দময়ন্তীর কাহিনি বর্ণনা

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি বৃহদশ্ব কর্তৃক নল দময়ন্তীর কাহিনি বর্ণনা

একদিন পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর সঙ্গে দুঃখিতমনে কাম্যকবনে বসে ছিলেন। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমাদের পৌরুষ আছে, বলবানদের সাহায্য নিয়ে আমরা আরও বলশালী হোতে পারি, কিন্তু আপনার, পাশা খেলার দোষের জন্য সকলে কষ্ট পাচ্ছি। রাজ্যশাসনই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, বনবাস নয়। আমরা অর্জুনকে ফিরিয়ে এনে এবং কৃষ্ণের সাহায্যে বারো বৎসরের পূর্বেই দুর্যোধনদের বধ করবো। শত্রুরা দুর হলে আপনি বন থেকে ফিরে যাবেন, তা হলে আপনার দোষ হবে না। তার পর আমরা যজ্ঞ করে পাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে যাবো। মহারাজা, এমনটা হোতে পারে যদি আপনি নির্বুদ্ধিতা, অলসতা আর ধর্মপরায়ণতা ত্যাগ করেন। প্রতারণার দ্বারা প্রতারককে বধ করা পাপ নয়। ধর্মজ্ঞ লোকের বিচারে দুঃসহ দুঃখের সময় এক দিন এক বছরের সমান মনে হয়। অতএব আমাদের তেরো দিনেই তেরো বছর পূর্ণ হয়েছে, দুর্যোধনাদিকে বধ করবার সময় এসেছে। দুর্যোধনের চর সর্বত্র আছে, অজ্ঞাতবাসের সময়ে সে আমাদের সন্ধান পেয়ে আবার বনবাসে পাঠাবে। যদি অজ্ঞাতবাসের সময় আমরা পূর্ণ করি তবে দুর্যোধন আবার আপনাকে পাশা খেলায় ডাকবে। আপনার দক্ষতা নেই, খেলতে খেলতে চেতনা হারিয়ে ফেলেন, সেজন্য আবার আপনি হারবেন।

যুধিষ্ঠির ভীমকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তেরো বছর শেষ হোলে তুমি আর অর্জুন নিশ্চয় দুর্যোধনকে বধ করবে। তুমি বলছ, সময় এসেছে, কিন্তু আমি মিথ্যা বলতে পারব না। প্রতারণা না করেও তুমি শক্রবধ করবে।

এমন সময় মহর্ষি বৃহদশ্ব সেখানে এলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। বৃহদশ্ব উপবেশন করলে যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, ধূর্ত পাশা খেলোয়াড় আমার রাজ্য ও ধন প্রতারণার দ্বারা হরণ করেছে। আমি সরল স্বভাব, দক্ষ পাশা খেলোয়াড় নই। তারা আমার প্রিয়তমা ভার্যাকে পাশা খেলার সভায় নিয়ে গিয়েছিল, তার পর দ্বিতীয়বার পাশা খেলায় জয়লাভ করে আমাদের বনে পাঠিয়েছে। পাশা খেলার সভায় তারা যে দারুণ কটূকথা বলেছে তা আমার মনে আছে, সমস্ত রাত্রি আমি সেই সব কথা চিন্তা করি। আমার চেয়ে মন্দভাগ্য ও দুঃখী কোনও রাজাকে আপনি জানেন কি?

মহর্ষি বৃহদশ্ব বললেন, যদি শুনতে চাও তবে এক রাজার কথা বলবো, যিনি তোমার চেয়েও দুঃখী ছিলেন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে বৃহদশ্ব নল রাজার এই উপাখ্যান বললেন।-

নিষধ দেশে নল নামে এক বলশালী সদাশয় রূপবান রাজা ছিলেন। তিনি বীরসেনের পুত্র, ব্রাহ্মণপালক, বেদজ্ঞ, পাশা খেলা প্রিয়, সত্যবাদী এবং বৃহৎ অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি। তাঁর সময়ে বিদর্ভ দেশে ভীম নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ও তার স্ত্রী ব্রহ্মর্ষি দমনকে সেবায় তুষ্ট করে একটি কন্যা ও তিনটি পুত্র লাভ করেন। কন্যার নাম দময়ন্তী, তিন পুত্রের নাম দম, দান্ত ও দমন। দময়ন্তীর মতো সুন্দরী ইহলোকে কেউ ছিলো না, দেবতারাও তাকে দেখে আনন্দিত হতেন।

লোকে নল ও দময়ন্তীর নিকট পরস্পরের রূপণ্ডণের প্রশংসা করতো, তার ফলে দেখা না হলেও তাঁরা পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হলেন। একদিন নল নির্জন বাগীচায় বেড়াতে বেড়াতে কতকণ্ডলি কনক বর্ণের হংস দেখতে পেলেন। তিনি একটিকে ধরলে সে বললে, রাজা, আমাকে মারবেন না, আমি আপনার প্রিয় কার্য করবো, দময়ন্তীর কাছে গিয়ে আপনার সম্বন্ধে এমন করে বলব যে তিনি অন্য পুরুষ কামনা করবেন না। নলের কাছে মুক্তি পেয়ে সেই হংস তার সহচরদের সঙ্গে বিদর্ভ দেশে দময়ন্তীর নিকট উপস্থিত হোলো। রাজকন্যা ও তার সখীরা সেই সকল আশ্চর্য হংস দেখে খুশি হয়ে তাদের ধরবার চেষ্টা করলেন। দময়ন্তী যাকে ধরতে গেলেন সেই হংস মানুষের ভাষায় বললো, নিষধরাজ নল কন্দর্পের মতো রূপবান, তাঁর সমান আর কেউ নেই। আপনি যেমন নারীরত্ন, নলও সেইরূপ পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনাদের দুʼজনের মিলন অতিশয় আনন্দজনক হবে। দময়ন্তী উত্তর দিলেন, তুমি নলের কাছে গিয়ে তাঁকেও এই কথা বলো। তখন হংস নিষধরাজ্যে গিয়ে নলকে সকল কথা জানালো।

দময়ন্তী নলের কথা চিন্তা করতে করতে দিন দিন বিবর্ণ ও ক্ষীণ হোতে লাগলেন। সখীদের মুখে কন্যার অসুস্থতার সংবাদ শুনে বিদর্ভরাজ ভাবলেন, কন্যা যৌবনলাভ করেছে, এখন তার স্বয়ংবর হওয়া উচিত। রাজা স্বয়ংবরের আয়োজন করলেন, তঁর নিমন্ত্রণে বহু রাজা বিদর্ভ দেশে এলেন।

এই সময়ে নারদ ও পর্বত দেবর্ষিদ্বয় দেবরাজ ইন্দ্রের নিকটে গেলেন। কুশল জিজ্ঞাসার পর ইন্দ্র বললেন, যে ধর্মজ্ঞ রাজারা সম্মুখ যুদ্ধে জীবন ত্যাগ করেন তাঁরা অক্ষয় স্বর্গ লাভ করেন। সেই ক্ষত্রিয় বীরগণ কোথায়? সেই প্রিয় রাজাদেরকে আর এখানে আসতে দেখি না কেন? নারদ বললেন, দেবরাজ, তার কারণ শুনুন-

বিদর্ভদেশের রাজকন্যা দময়ন্তী সৌন্দর্যে সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, শীঘ্রই তার স্বয়ংবর হবে। সেই নারীরত্নকে পাবার আশায় সকল রাজা আর রাজপুত্র স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন। এমন সময় অগ্নি প্রভৃতি দেবতারা ইন্দ্রের কাছে এলেন এবং নারদের কথা শুনে খুশি হয়ে বললেন, আমরাও যাব।

ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, ও যম তাদের বাহন ও অনুচর সহ বিদর্ভ দেশে যাত্রা করলেন। পথে তারা সাক্ষাৎ কামদেবের মতো নলকে দেখে বিস্মিত হলেন, তাদের দময়ন্তীকে লাভের আশা দূর হোলো। দেবগণ তাঁদের বিমান আকাশে রেখে ভূতলে নেমে নলকে বললেন, নিষধরাজ, তুমি সত্যব্রত, দূত হয়ে আমাদের সাহায্য করো। নল হাতজোড় কোরে বললেন, করবো। আপনারা কে? আমাকে কার দৌত্য করতে হবে? ইন্দ্র বললেন, আমরা অমর, দময়ন্তীর জন্য এসেছি। তুমি গিয়ে তাঁকে বলো যে দেবতারা তাঁকে চান, তিনি ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ ও যম এই চারজনের একজনকে বরণ করুন। নল বললেন, আমিও তাকে চাই, নিজেই যখন প্রার্থী তখন পরের জন্য কি করে বলবো? দেবগণ, আমাকে ক্ষমা করুন। দেবতারা বললেন, তুমি করবো বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, এখন তার অন্যথা করতে পার না, অতএব শীঘ্র যাও। নল বললেন, সুরক্ষিত অন্তঃপুরে আমি কি করে প্রবেশ করব? ইন্দ্র বললেন, তুমি প্রবেশ করতে পারবে।

সখীগণের সঙ্গে দময়ন্তী যেখানে বসে ছিলেন সেখানে নল উপস্থিত হলেন। দময়ন্তী হাসিমুখে বললেন, হে সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ, তুমি কে? আমার হৃদয় হরণ করতে কেন এখানে এসেছ? নল বললেন, কল্যাণী, আমি নল, দেবরাজ ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, ও যম এই চার দেবতার দূত হয়ে তোমার কাছে এসেছি, তাঁদের একজনকে পতিরূপে বরণ করো। দময়ন্তী বললেন, রাজা, আমি এবং আমার যা কিছু আছে সবই তোমার, তুমিই আমার প্রতি অনুরক্ত হও। হংসদের কাছে সংবাদ পেয়ে তোমাকে পাবার জন্যই আমি স্বয়ংবরে রাজাদের আনিয়েছি। তুমি যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করো তবে আমি আত্মহত্যা করবো। নল বললেন, দেবতারা থাকতে মানুষকে চাও কেন? আমি তাঁদের চরণধুলির তুল্যও নই, তাদের প্রতিই তোমার মন দেওয়া উচিত। দময়ন্তী জলভরা চোখে হাত জোড় কোরে বললেন, দেবগণকে আমি প্রণাম করি। মহারাজ, আমি তোমাকেই পতিত্বে বরণ করবো। নল বললেন, কল্যাণী, আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দেবগণের দূত রূপে এসেছি, এখন আমি কি করবো? দময়ন্তী বললেন, আমি নির্দোষ উপায় বলছি শোনো। ইন্দ্রাদি লোকপালগণের সঙ্গে তুমিও স্বয়ংবর সভায় এস, আমি তাদের সম্মুখেই তোমাকে বরণ করবো।

নল ফিরে এসে দেবগণকে বললেন, আমি আপনাদের বার্তা দময়ন্তীকে জানিয়েছি, কিন্ত তিনি আমাকেই বরণ করতে চান। তিনি আপনাদের সকলকে এবং আমাকেও স্বযংবর সভায় আসতে বলেছেন।

বিদর্ভরাজ ভীম শুভদিনে শুভক্ষণে স্বয়ংবর সভা আহ্বান করলেন। নানা দেশের রাজারা সুসজ্জিত হোয়ে নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হলেন। দময়ন্তী সভায় এলে তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর রূপের প্রতি রাজাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হোয়ে রইল। তারপর প্রত্যেক রাজার নাম ও তাদের গুণ ও কীর্তিকলাপ বর্ণনা করা হোলো। দময়ন্তী তখন দেখলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের আকৃতি একই প্রকার, প্রত্যেককেই নল বলে মনে হয়। দময়ন্তী ভাবতে লাগলেন, এঁদের মধ্যে কে দেবতা আর কে নল তা কোন্‌ উপায়ে বুঝবো?  দেবতার যেসব লক্ষণ শুনেছি, তা এই পাঁচজনের মধ্যে দেখছি না। তখন দময়ন্তী কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবগণের উদ্দেশে নমস্কার করে বললেন, আমি হংসগণের বাক্য শুনে নিষধরাজকে পতিত্বে বরণ করেছি, আমার সেই সত্য যেন রক্ষা পায়। দেবগণ নলকে দেখিয়ে দিন, তাঁরা নিজরূপ ধারণ করুন যাতে আমি নলকে চিনতে পারি। দময়ন্তীর প্রার্থনা শুনে এবং নলের প্রতি তার পরম অনুরাগ জেনে ইন্দ্রাদি চারজন দেবতা স্বরূপে প্রকট হলেন।

দময়ন্তী দেখলেন, দেবগণের শরীর স্বেদহীন, চোখ অপলক। তাঁদের মালা অম্লান, শরীরের কোনো ছায়া নেই, ভূমি স্পর্শ না করেই তাঁরা বসে আছেন। কেবল একজনের ছায়া আছে, তাঁর মালা কিছুটা ম্লান, শরীর স্বেদযুক্ত, চোখে পলক পড়ছে, এই দেখে দময়ন্তী বুঝলেন তিনি নিষধরাজ নল।

তখন দময়ন্তী নলের গলায় সুদৃশ্য মালা পরিয়ে দিলেন। তাই দেখে অন্য রাজারা হাহাকার কোরে উঠলেন, দেবতা ও মহর্ষিগণ সাধু সাধু বললেন। নল খুশিমনে দময়ন্তীকে বললেন, কল্যাণী, তুমি দেবগণের উপস্থিতিতে মানুষকেই বরণ করলে, আমাকে তোমার পতি ও আজ্ঞাবহ বলে জেনো। যত দিন দেহে প্রাণ থাকবে তত দিন আমি তোমারই অনুরক্ত থাকব।

দেবতারা খুশি হোয়ে নলকে বর দিলেন। ইন্দ্র বললেন, যজ্ঞকালে তুমি আমাকে প্রত্যক্ষ দেখবে এবং মৃত্যুর পর উত্তম গতি লাভ করবে। অগ্নি বললেন, তুমি যেখানে ইচ্ছা করবে সেখানেই আমার আবির্ভাব হবে এবং অন্তিমে তুমি দিব্যলোকে যাবে। যম বললেন, তুমি যে খাদ্য রান্না করবে তাই সুস্বাদু হবে, তুমি চিরকাল ধর্মপথে থাকবে। বরুণ বললেন, তুমি যেখানে জল চাইবে সেখানেই পাবে। দেবতারা সকলে মিলে নলকে যুগল সন্তান লাভের বর দিলেন।

বিবাহের পর কিছুকাল বিদর্ভ দেশে থেকে নল তাঁর পত্নীর সঙ্গে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন। তিনি অশ্বমেধ এবং বিবিধ যজ্ঞ করলেন। যথাকালে দময়ন্তী একটি পুত্র ও একটি কন্যা প্রসব করলেন, তাদের নাম ইন্দ্রসেন ও ইন্দ্রসেনা।

স্বয়ংবর থেকে ফেরবার পথে দেবতাদের সঙ্গে দ্বাপর আর কলির দেখা হল। কলি বললেন, দময়ন্তীর উপর আমার আসক্তি হয়েছে, তাকে স্বয়ংবরে পাবার জন্য যাচ্ছি। ইন্দ্র হেসে বললেন, স্বয়ংবর হয়ে গেছে, আমাদের সামনেই দময়ন্তী নল রাজাকে বরণ করেছেন। কলি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, দেবগণকে ত্যাগ কোরে সে মানুষকে বরণ করেছে, এজন্য তার কঠোর দণ্ড হওয়া উচিৎ। ইন্দ্র বললেন, কলি, নলের ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন রাজাকে যে অভিশাপ দেয় সে নিজেই অভিশপ্ত হয়ে ঘোর নরকে পড়ে। দেবতারা চলে গেলে কলি দ্বাপরকে বললেন, আমি ক্রোধ সংবরণ করতে পারছি না, নলের দেহে অধিষ্ঠান করে তাকে রাজ্যভ্রষ্ট করবো। তুমি আমাকে সাহায্য করবার জন্য পাশার মধ্যে প্রবেশ কর।

কলি নিষধরাজ্যে এসে নলের ত্রুটি খুঁজতে লাগলেন। বারো বছর পরে একদিন কলি দেখলেন, নল মূত্রত্যাগের পর পা না ধুয়ে শুধু আচমন করে আহ্নিক করছেন। সেই অবসরে কলি নলের দেহে প্রবেশ করলেন। তার পর তিনি নলের ভাই পুষ্করের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি নলের সঙ্গে পাশা খেলো, আমার সাহায্যে নিষধরাজ্য জয় করতে পারবে। পুষ্কর সম্মত হয়ে নলের কাছে চললেন, কলি বলদের রূপ ধারণ কোরে পিছনে পিছনে গেলেন।

নল পুষ্করের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না, পাশা খেলা শুরু করলেন এবং ক্রমে ক্রমে ধনরত্ন, যানবাহন, বসন প্রভৃতি বহুপ্রকার সামগ্রী হারলেন। রাজাকে পাশা খেলায় মত্ত দেখে মন্ত্রী, পুরবাসিগণ ও দময়ন্তী তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কলির প্রভাবে নল কোনও কথাই বললেন না। দময়ন্তী আবার নিজে গিয়ে এবং তাঁর ধাত্রী বৃহৎসেনাকে পাঠিয়ে রাজাকে পাশা খেলা বন্ধ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্ত কোনও ফল হোলো না। তখন দময়ন্তী সারথি বার্ষ্ণেয়কে ডেকে আনিয়ে বললেন, রাজা বিপদে পড়েছেন, তুমি তাকে সাহায্য করো। তিনি পুষ্করের কাছে যত হেরে যাচ্ছেন ততই তার খেলার আগ্রহ বাড়ছে। রাজা মোহগ্রস্ত হয়েছেন তাই তাঁর শুভার্থী আর আমার কথা শুনছেন না। আমার মন ব্যাকুল হয়েছে, হয়তো তার রাজ্যনাশ হবে। তুমি দ্রুতগামী রথে আমার পুত্রকন্যাকে বিদর্ভ রাজ্যে তাদের মাতামহের কাছে নিয়ে যাও। সেখানে আমার দুই সন্তান, রথ ও ঘোড়া রেখে তুমি সেখানেই থেকো অথবা যেখানে ইচ্ছা হয় যেয়ো। সারথি বার্ষ্ণেয় মন্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে বিদর্ভ রাজধানীতে গেল এবং নলের পুত্র-কন্যা, রথ ও অশ্ব সেখানে রেখে ভীম রাজার কাছে বিদায় নিলো। তার পর শোকার্ত হয়ে নানা স্থানে ভ্রমণ করতে করতে অযোধ্যায় গেল এবং সেখানে রাজা ঋতুপর্ণের সারথির কাজে নিযুক্ত হল।

নলের রাজ্য ও সমস্ত ধন পাশা খেলায় জিতে নিয়ে পুষ্কর হেসে বললেন, আপনার সর্বস্ব আমি জয় করেছি, কেবল দময়ন্তী অবশিষ্ট আছেন, যদি ভালো মনে করেন তবে এখন তাঁকেই পণ রাখুন। নলের মন দুঃখে বিদীর্ণ হোলো, তিনি কিছু না বলে তাঁর সকল অলংকার খুলে ফেললেন এবং বিপুল ঐশ্বর্য ত্যাগ করে একবস্ত্রে রাজ্য থেকে বেরিয়ে গেলেন। দময়ন্তীও একবস্ত্রে তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন।

পু্ষ্করের নিষেধ মান্য কোরে কোনও লোক নল-দময়ন্তীকে কোনো সমাদর করলে না। তারা কেবল জলপান করে নগরের প্রান্তে তিনরাত্রি বাস করলেন। ক্ষুধার্ত নল ঘুরতে ঘুরতে কতকগুলি পাখি দেখতে পেলেন, তাদের পালক স্বর্ণকান্তি। নল ভাবলেন, এই পাখিগুলির মাংস দিয়ে আজ ক্ষুধা মিটাতে হবে। এই ভেবে তিনি তার পোশাক খুলে নিয়ে পাখিদের উপর চাপা দিলেন। পাখিরা সেই পোশাক নিয়ে আকাশে উঠে বললো, নল, তুমি যে পাশা নিয়ে খেলা করেছিলে আমরাই সেই পাশা। তুমি পোশাক পরে গেলে আমাদের আনন্দ হবে না। বিবস্ত্র নল দময়ন্তীকে বললেন, যাদের প্রকোপে আমি ঐশ্বর্যহীন হয়েছি, যাদের জন্য আমরা প্রাণ ধারণের জন্য উপযুক্ত খাদ্য আর নিষধবাসীর সাহায্য পাচ্ছি না, তারাই পাখি হয়ে আমার পোশাক নিয়ে উড়ে গেছে। আমি দুঃখে জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়েছি। আমি তোমার স্বামী, তোমার ভালোর জন্য যা বলছি শোন। -এখান থেকে কতকগুলি পথ অবন্তী ও ঋক্ষবান পর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গেছে। ওখানে প্রচুর ফলমুলের গাছ আর ঋষিদের আশ্রম আছে। এই বিদর্ভ দেশের পথ, এই কোশল দেশের, ওই দক্ষিণাপথের। নল কাতর হয়ে এই সব কথা বার বার দময়ন্তীকে বলে সেখানে চলে যেতে অনুরোধ করলেন।

দময়ন্তী বললেন, তোমার কথায় আমার হৃদয় কাঁপছে, সর্বাঙ্গ অবসন্ন হচ্ছে। তোমাকে ত্যাগ করে আমি কি করে অন্যত্র যাবো? চিকিৎসকরা বলেন, সকল দুঃখে স্ত্রীর সমান ঔষধ নেই। নল বললেন, তুমি কেন আশঙ্কা করছ, আমি নিজের প্রাণ ত্যাগ করতে পারি কিন্তু তোমাকে পারি না। দময়ন্তী বললেন, মহারাজ, তবে বিদর্ভের পথ দেখাচ্ছ কেন? যদি আমার আত্মীয়দের কাছেই আমাকে পাঠাতে চাও তবে তুমিও চলো না কেন? আমার পিতা বিদর্ভরাজ তোমাকে সসম্মানে আশ্রয় দেবেন, তুমি আমাদের গৃহে সুখে থাকতে পারবে। নল বলালেন, পূর্বে সেখানে যখন গিয়েছিলাম তখন আমি ছিলাম একজন রাজা, এখন নিঃস্ব হয়ে কি করে যাবো?

নল ও দময়ন্তী একই পোশাক পরে চলতে চলতে একটি পথিকদের বিশ্রাম স্থানে এলেন এবং মাটির উপরে শয়ন করলেন। দময়ন্তী তখনই ঘুমিয়ে পড়লেন। নল ভাবলেন, দময়ন্তী আমার জন্যই দুঃখ ভোগ করছে, আমি না থাকলে হয়তো পিতৃগৃহে যাবে। কলির দুষ্ট প্রভাবে নল দময়ন্তীকে ত্যাগ করাই স্থির করলেন এবং যে পোশাক তাঁরা দু’জনেই পরে ছিলেন তা দ্বিখণ্ড কোরে অর্ধেক পরে নিয়ে নিদ্রিতা দময়ন্তীকে পরিত্যাগ করে নল দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন, কিন্ত আবার ফিরে এসে স্ত্রীকে দেখে বিলাপ করতে লাগলেন। এইরূপে নল বার বার ফিরে এসে অবশেষে চলে গেলেন।

ঘুম থেকে উঠে নলকে না দেখে দময়ন্তী শোক ও ভয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি পতির খোঁজ করতে শ্বাপদসংকুল বনে প্রবেশ করলেন। সহসা বিশাল এক ক্ষুধার্ত অজগর তাকে জড়িয়ে ধরলো। দময়ন্তীর আর্তনাদ শুনে এক ব্যাধ তখনই সেখানে এল এবং তীক্ষ্ণ অস্ত্রে অজগরের মুখ চিরে দময়ন্তীকে উদ্ধার করলো। অজগরকে বধ করে ব্যাধ দময়ন্তীকে জল এবং খাবার এনে দিলো। দময়ন্তী আহার করলে ব্যাধ বললো, তুমি কে, কেন এখানে এসেছ? দময়ন্তী সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। অর্ধেক পোশাক পরা দময়ন্তীর রূপ দেখে ব্যাধ কামার্ত হয়ে তাকে ধরতে গেল। দময়ন্তী বললেন, যদি আমি নিষধরাজ ভিন্ন অন্য পুরুষকে মনে মনেও চিন্তা না করে থাকি তবে এই ক্ষুদ্র ব্যাধের বিনাশ হোক। ব্যাধ তখনই প্রাণহীন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

তার পর দময়ন্তী ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করলেন, সিংহ, বাঘ, ভল্লুকাদি প্রাণী এবং ম্লেচ্ছ, তস্কর প্রভৃতি জাতি সেখানে বাস করে। তিনি পাগলিনীর মতো সবাইকে নলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তিন দিন তিন রাত উত্তর দিকে গিয়ে তিনি এক তপোবনে উপস্থিত হলেন। তপস্বীরা প্রশ্ন করলেন, তুমি  কে? দময়ন্তী তাঁর ইতিহাস জানিয়ে বললেন, যদি কয়েক দিনের মধ্যে নল রাজার দেখা না পাই তবে আমি দেহত্যাগ করব। তপস্বীরা বললেন, কল্যাণী, তোমার মঙ্গল হবে, আমরা দেখছি তুমি শীঘ্রই নিষধরাজের দর্শন পাবে। তিনি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আবার নিজ রাজ্য শাসন করবেন। এই বলে তপস্বিগণ অন্তর্হিত হলেন। দময়ন্তী বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, আমি কি স্বপ্ন দেখলাম? তপস্বীরা কোথায় গেলেন? তাঁদের আশ্রম, নদী, ফলপুষ্পশোভিত বৃক্ষ সব কোথায় গেল?

নলের খোঁজে আবার যেতে যেতে দময়ন্তী এক নদীতীরে এসে দেখলেন, এক বৃহৎ বণিকের দল অনেক হাতি, ঘোড়া, রথ নিয়ে নদী পার হচ্ছে। দময়ন্তী সেই যাত্রিদলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তার পাগলিনীর মতো অর্ধেক পোশাক পরা দুর্বল মলিন চেহারা দেখে কতকগুলি লোক ভয়ে পালিয়ে গেল, কেউ অন্য লোককে ডাকতে গেল, কেউ হাসতে লাগল। একজন বললো, তুমি কি মানবী, যক্ষী, না রাক্ষসী? আমরা তোমার শরণ নিলাম, আমাদের রক্ষা করো, যাতে এই বণিকের দল নিরাপদে যেতে পারে তা করো। দময়ন্তী তাঁর পরিচর় দিলেন এবং নলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন. শুচি নামক বণিকদের দলপতি বললেন, নলকে আমরা দেখি নি, এই বনে আপনি ভিন্ন অন্য কোনও মানুষও দেখিনি। আমরা বাণিজ্যের জন্য চেদিরাজ সুবাহুর রাজ্যে যাচ্ছি।

নলের দেখা পাবেন এই আশায় দময়ন্তী সেই বণিকদলের সঙ্গে চলতে লাগলেন কিছু দূর গিয়ে সকলে এক বৃহৎ জলাশয়ের কাছে উপস্থিত হলেন। পরিশ্রান্ত বণিকের দল সেখানে রাত্রিযাপনের আয়োজন করলো। সকলে ঘুমিয়ে পড়লে মাঝরাত্রে এক দল বুনো হাতি বণিকদের পালিত হাতিদের মারবার এলে সহসা আক্রান্ত হয়ে বণিকরা ভয়ে উদভ্রান্ত হয়ে পালাতে লাগল, বুনো হাতির আক্রমণে অনেকে মারা গেল, বহু উট ও ঘোড়াও মারা গেল। অবশিষ্ট বণিকরা বলতে লাগল, আমরা বাণিজ্যদেবতা মণিভদ্র এবং কুবেরের পূজা করি নি তারই এই ফল। কয়েকজন বললো, পাগলিনীর মতো সেই নারীই মায়াবলে এই বিপদ ঘটিয়েছে। নিশ্চয় সে রাক্ষসী, যক্ষী বা পিশাচী, তাকে দেখলে আমরা হত্যা করবো।

এই কথা শুনতে পেয়ে দময়ন্তী দ্রুত বনের মধ্যে পালিয়ে গেলেন। তিনি বিলাপ করে বললেন, এই নির্জন অরণ্যে যে আশ্রয় পেয়েছিলাম তাও হারালাম, এও আমার মন্দভাগ্যের ফল। আমি স্বয়ংবরে ইন্দ্রাদি দেবতাগণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তাদেরই কোপে আমার এই দুর্দশা হয়েছে। বণিকদের মধ্যে কয়েকজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন, দময়ন্তী তাদের সঙ্গে যেতে লাগলেন। বহুদিন পর দময়ন্তী একদিন সন্ধ্যায় চেদিরাজ সুবাহুর নগরে উপস্থিত হলেন। তাকে পাগলিনীর মতো দেখে গ্রামের বালকগণ কৌতুহলের বশে তাঁর অনুসরণ করতে লাগল। দময়ন্তী রাজপ্রাসাদের নিকটে এলে রাজামাতা তাঁকে দেখতে পেয়ে এক ধাত্রীকে বললেন, ওই দুঃখিনী নারীকে লোকে কষ্ট দিচ্ছে, তুমি ওকে নিয়ে এসো।

দময়ন্তী এলে রাজমাতা বললেন, এই দুর্দশা সত্বেও তোমাকে রূপবতী দেখছি, তুমি কে? দময়ন্তী বললেন, আমি পতিব্রতা সদবংশীয়া। আমার স্বামীর অসংখ্য গুণ, কিন্ত দৈববশে পাশা খেলায় পরাজিত হয়ে তিনি বনে এসেছিলেন, সেখানে আমাকে নিদ্রিত অবস্থায় ত্যাগ করে চলে গেছেন। পাগলিনীর মতো আমি তার খোঁজ করছি। রাজমাতা বললেন, কল্যাণী, তোমার উপর আমার স্নেহ হয়েছে, আমার কাছেই তুমি থাকো। আমার লোকেরা তোমার পতির খোঁজ করবে, হয়তো তিনি ঘুরতে ঘুরতে নিজেই এখানে এসে পড়বেন।

দময়ন্তী বললেন, আমি আপনার কাছে থাকবো, কিন্তু কারও উচ্ছিষ্ট খাবো না বা পা ধুইয়ে দেবো না। পতির অন্বেষণের জন্য আমি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দেখা করবো, কিন্তু অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলবো না। যদি কোনও পুরুষ আমাকে প্রার্থনা করে তবে আপনি তাকে শাস্তি দেবেন। রাজমাতা সানন্দে সম্মত হলেন, এবং নিজ কন্যা সুনন্দাকে ডেকে বললেন, ইনি তোমার সমবয়সী, তাই তোমার সখী হবেন। সুনন্দা খুশি মনে দময়ন্তীকে নিজগৃহে নিয়ে গেলেন।

দময়ন্তীকে ত্যাগ করে নল গহন বনে গিয়ে দেখলেন, ভয়ঙ্কর আগুন জলছে এবং কেউ তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকছে আর বলছে মহারাজ নল, শীঘ্র আসুন। নল আগুনের কাছে এলে এক বিশাল সাপ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, রাজা, আমি কর্কোটক নাগ, মহর্ষি নারদকে প্রতারিত করেছিলাম সেজন্য তিনি শাপ দিয়েছেন এই জায়গায় পাথরের মতো পড়ে থাকো, নল যখন তোমাকে অন্যত্র নিয়ে যাবেন তখন শাপমুক্ত হবে। আপনি আমাকে রক্ষা করুন, আমি বন্ধু হয়ে আপনাকে সৎপরামর্শ দেব। এই বলে সেই বিশাল কর্কোটক সাপ আঙ্গুলের মতো ছোট্ট হয়ে গেলে নল তাকে নিয়ে আগুনের বাইরে চলে এলেন।

যেতে যেতে কর্কোটক বললেন, নিষধরাজ, আপনি পা গুণে গুণে চলুন, আমি আপনার মহা উপকার করবো। নল দশবার পা ফেলার পর কর্কোটক তাঁকে দংশন করলেন, তৎক্ষণাৎ নলের রূপ বিকৃত হয়ে গেল। কর্কোটক নিজ মূর্তি ধারণ করে বললেন, মহারাজ, লোকে আপনাকে যাতে চিনতে না পারে সেজন্য আপনার প্রকৃত রূপ বিকৃত করে দিলাম। যে কলির বশে আপনি প্রতারিত ও মহাদুঃখে পতিত হয়েছেন সে এখন আমার বিষে আক্রান্ত হয়ে আপনার দেহের মধ্যে কষ্টে বাস করবে। আপনি অযোধ্যায় ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা খতুপর্ণের কাছে গিয়ে বলুন যে আপনি বাহুক নামক সারথি। তিনি আপনার নিকট ঘোড়া সুশিক্ষিত করবার বিদ্যা শিখে নিয়ে আপনাকে পাশা খেলায় দক্ষ করবেন। ঋতুপর্ণ আপনার বন্ধু হবেন, আপনিও পাশা খেলায় পারদর্শী হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবেন এবং পত্নী, পুত্রকন্যা ও রাজ্য ফিরে পাবেন। যখন পূর্বরূপ ধারণের ইচ্ছা হবে তখন আমাকে স্মরণ করে এই পোশাক পরবেন। এই বলে কর্কোটক নলকে দিব্য পোশাক দান করে অন্তর্হিত হলেন।

দশ দিন পরে নল ঋতুপর্ণ রাজার কাছে এসে বললেন, আমার নাম বাহুক, অশ্বচালনায় আমার তুল্য নিপুণ লোক পৃথিবীতে নেই। সংকটকালে এবং কোনও কার্যে নৈপুণ্যের প্রয়োজন হলে আপনাকে আমি মন্ত্রণা দিতে পারব, রন্ধনবিদ্যাও আমি বিশেষরূপে জানি। সর্বপ্রকার শিল্প ও কঠিন কাজেও আমি যত্নশীল হব। ঋতুপর্ণ বললেন, বাহুক, তুমি আমার কাছে থাক, তোমার ভাল হবে। আজ থেকে তুমি আমার অশ্বাধ্যক্ষ নিযুক্ত হলে বাষ্ণেয় ও জীবল তোমার সঙ্গে সহযোগিতা করবে।

ঋতুপর্ণের আশ্রয়ে নল সসম্মানে বাস করতে লাগলেন। দময়ন্তীকে স্মরণ করে তিনি প্রত্যহ মনে মনে বলতেন, আমার দুঃখিনী সহধর্মিনী আজ কোথায় আছে তুমি? এই হতভাগ্যকে স্মরণ করে তুমি আজ কার আশ্রয়ে বাস করছো?

একদিন জীবল বললো, বাহুক, কোন নারীর জন্য তুমি প্রত্যেক দিন এমন বিলাপ করো? নল বললেন, কোনও এক মন্দবুদ্ধি পুরুষ ঘটনাক্রমে তার অত্যন্ত আদরণীয়া পত্নীর সাথে বিচ্ছেদের ফলে শোকে কাতর হোয়ে ভ্রমণ করছে।

বিদর্ভরাজ ভীম তার কন্যা ও জামাতাকে খুঁজে বের করবার জন্য বহু ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করলেন। তারা প্রচুর পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে নানা দেশে নল-দময়ন্তীকে খুঁজতে লাগলেন। সুদেব নামে এক ব্রাহ্মণ চেদি দেশে এসে রাজভবনের সংলগ্ন বাগীচায় দময়ন্তীকে দেখতে পেলেন। সুদেব নিজের পরিচয় দিয়ে দময়ন্তীকে তাঁর পিতা মাতা ও পুত্রকন্যার কুশল জানালেন। ভাইয়ের প্রিয় বন্ধু সুদেবকে দেখে দময়ন্তী কাঁদতে লাগলেন। সুনন্দার কাছে সংবাদ পেয়ে রাজমাতা তখনই সেখানে এলেন এবং সুদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্রাহ্মণ, ইনি কার স্ত্রী, কার কন্যা? আত্মীয়দের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন কেন? আপনিই বা এঁকে জানলেন কি করে ? সুদেব নল-দময়ন্তীর ইতিহাস বলে তারপর বললেন, দেবী, এঁর খোঁজে আমরা সর্বত্র ভ্রমণ করেছি, এখন আপনার এখানে এঁকে পেলাম। এঁর অতুলনীয় রূপ এবং দুই ভ্রুর মধ্যে যে পদ্মের মতো জটুল রয়েছে তা দেখেই এঁকে আমি চিনেছি।

সুনন্দা দময়ন্তীর ললাট মুছে দিলেন, তখন সেই জটুল মেঘমুক্ত চন্দ্রের মতো সুস্পষ্ট হোলো। তা দেখে রাজমাতা ও সুনন্দা দময়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। রাজমাতা বললেন, তুমি আমার বোনের মেয়ে, ওই জটুল দেখে চিনেছি। দশার্ণরাজ সুদামা তোমার মা ও আমার পিতা, তোমার জন্মকালে দশার্ণদেশে পিতৃগৃহে আমি তোমাকে দেখেছিলাম। দময়ন্তী, তোমার পক্ষে আমার গৃহ তোমার পিতৃগৃহেরই সমান। দময়ন্তী, আনন্দিত হয়ে মাসীকে প্রণাম কোরে বললেন, আমি অপরিচিত থেকেও আপনার কাছে সুখে বাস করেছি, এখন আরও সুখে থাকতে পারবো। কিন্তু মাসী, পুত্রকন্যার বিচ্ছেদে আমি শোকার্ত হয়ে আছি, অতএব আজ্ঞা দিন আমি বিদর্ভ দেশে যাবো।

রাজমাতা তার পুত্রের অনুমতি নিয়ে বিশাল সৈন্যদল সহ দময়ন্তীকে বিদভরাজ্যে পাঠিয়ে দিলেন। রাজা ভীম আনন্দিত হয়ে এক হাজার গরু, গ্রাম ও ধন দান কোরে সুদেবকে তুষ্ট করলেন। দময়ন্তী তার মাকে বললেন, যদি আমার জীবন রক্ষা করতে চান তবে আমার পতিকে আনবার চেষ্টা করুন। রাজার আজ্ঞায় ব্রাহ্মণগণ চতুর্দিকে যাত্রা করলেন। দময়ন্তী তাঁদের বলে দিলেন, আপনারা সকল জায়গায় এই কথা বার বার বলবেন—‘অর্ধেক পোশাক কেটে নিয়ে নিদ্রিতা স্ত্রীকে অরণ্যে ফেলে কোথায় গেছো? সে এখনও অর্ধেক পোশাক পরে তোমার জন্য কান্নাকাটি করছে। রাজা, দয়া কর, তুমি ফিরে এসো। আপনারা এইরূপ বললে কোনও লোক যদি উত্তর দেন তবে ফিরে এসে আমাকে জানাবেন, কিন্তু কেউ যেন আপনাদের চিনতে না পারে।

দীর্ঘকাল পরে পর্ণাদ নামে এক ব্রাহ্মণ ফিরে এসে বললেন, আমি ঋতুপর্ণ রাজার সভায় গিয়ে আপনার বাক্য বলেছি, কিন্তু তিনি বা কোনও সভাসদ উত্তর দিলেন না। তার পর আমি বাহুক নামক এক সারথির কাছে গেলাম। সে রাজার সারথি, কুরূপ, দ্রুত রথচালনায় নিপুণ, সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করতেও জানে। সে বহুবার নিঃশ্বাস ফেলে কাঁদতে কাঁদতে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলো, তার পর বললো, সতী স্ত্রী বিপদে পড়লেও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করেন। পাখি যার পোশাক নিয়ে উড়ে গিয়েছিল, সেই মোহগ্রস্ত অসহায় পতি পরিত্যাগ করে চলে গেলেও সতী নারী ক্রুদ্ধ হন না। এই বার্তা শুনে দময়ন্তী তাঁর মাকে বললেন, আপনি পিতাকে কিছু জানাবেন না। এখন সুদেব শীঘ্র ঋতুপর্ণের রাজধানী অযোধ্যায় যান এবং নলকে আনবার চেষ্টা করুন।

দময়ন্তী পর্ণাদকে নানাবিধ উপহার দিয়ে বললেন, নল এখানে এলে আমি আবার আপনাকে ধনদান করব। পর্ণাদ কৃতার্থ হয়ে চলে গেলে দময়ন্তী সুদেবকে বললেন, আপনি সত্বর অযোধ্যায় গিয়ে রাজা ঋতুপর্ণকে বলুন, ভীম রাজার কন্যা দময়ন্তীর পুনর্বার স্বয়ংবর হবে, কাল সূর্যোদয়কালে তিনি দ্বিতীয় পতি বরণ করবেন, কারণ নল জীবিত আছেন কিনা জানা যাচ্ছে না। বহু রাজা ও রাজপুত্র স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন, আপনিও যান।

সুদেবের কাছে দয়মন্তীর স্বয়ংবর হওয়ার সংবাদ শুনে ঋতুপর্ণ নলকে বললেন, বাহুক, আমি একদিনের মধ্যে বিদর্ভরাজ্যে দময়ন্তীর স্বয়ংবরে যেতে ইচ্ছা করি। নল দুঃখিত হয়ে ভাবলেন, আমার সঙ্গে মিলিত হবার জন্যই কি তিনি এই উপায় স্থির করেছেন? আমি অপরাধী, তাঁকে প্রতারিত করেছি, হয়তো সেজন্যই তিনি এই উপায় স্থির করেছেন। আমার বিশ্বাস, তিনি কখনও স্বয়ংবর করবেন না, বিশেষত তার যখন সন্তান রয়েছে। ঋতুপর্ণকে নল বললেন যে তিনি একদিনেই বিদর্ভনগরে পৌঁছবেন, তার পর তিনি অশ্বশালায় গিয়ে কয়েকটি দ্রুতগামী চারটি ঘোড়া বেছে নিয়ে রথে যুক্ত করলেন।

ঋতুপর্ণ রথে উঠলে নল সারথি বাষ্ণেয়কে তুলে নিলেন এবং মহাবেগে রথ চাললেন। বাষ্ণেয় ভাবলো, এই বাহুক কি ইন্দ্রের সারথি মাতলি না স্বয়ং নল রাজা? বয়সে নলের মতো হলেও এ দেখতে কুরূপ ও বামনসদৃশ। বাহুকের রথচালনা দেখে ঋতুপর্ণ বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। সহসা তার উত্তরীয় উড়ে যাওয়ায় তিনি বললেন, রথ থামাও, বাষ্ণেয় আমার উত্তরীয় নিয়ে আসুক। নল বললেন, আমরা এক যোজন ছাড়িয়ে এসেছি, এখন উত্তরীয় পাওয়া অসম্ভব। ঋতুপর্ণ বিশেষ খুশি হলেন না। তিনি একটি বহেড়া গাছ দেখিয়ে বললেন, বাহুক, সকলে সব বিষয় জানে না, তুমি আমার গণনার শক্তি দেখ। এই গাছ থেকে ভূমিতে পড়ে যাওয়া পাতার সংখ্যা একশ এক, ফলের সংখ্যাও তাই। এর ডালে পাঁচ কোটি পাতা আর দু হাজার পঁচানব্বইটি ফল আছে, তুমি গণনা করে দেখো।

বাহুক বলল আপনি গর্ব করছেন, আমি এই বৃক্ষ কেটে ফেলে পাতা ও ফল গণনা করবো। রাজা বললেন, এখন বিলম্ব করবার সময় নয়। নল বললেন, আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আর যদি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকেন তবে সম্মুখের পথ ভাল আছে, বাষ্ণেয় আপনাকে নিয়ে যাক। ঋতুপর্ণ অনুনয় করে বললেন, বাহুক, তোমার তুল্য সারথি পৃথিবীতে নেই, আমি তোমার শরণাপন্ন, তুমি দ্রুত চলো। যদি আজ সূর্যাস্তের আগে বিদর্ভদেশে যেতে পারো তবে তুমি যা চাইবে তাই দেবো। নল বললেন, আমি পাতা আর ফল গণনা করে বিদর্ভে যাবো। রাজা অনিচ্ছায় বললেন, আমি শাখার এক অংশের পত্র ও ফলের সংখ্যা বলছি, তাই গণনা করে সন্তুষ্ট হও। নল শাখা কেটে গণনা করে বিস্মিত হয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার শক্তি অতি অদ্ভুত, আমাকে এই বিদ্যা শিখিয়ে দিন, তার পরিবর্তে আপনি আমার দ্রুত অশ্ব চালনার বিদ্যা শিখে নিন।।

ঋতুপর্ণ দ্রুত অশ্ব চালনার বিদ্যা শিখে নিয়ে নলকে দক্ষতার সঙ্গে পাশা খেলার মন্ত্রগুপ্তি শিখিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ কলি কৰ্কোটক বিষ বমন করতে করতে নলের দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন এবং অন্যের অদৃশ্য হয়ে করজোড়ে ক্রুদ্ধ নলকে বললেন, মহারাজা, আমাকে অভিশাপ দিও না, আমি তোমাকে পরম কীর্তি দান করব। যে লোক তোমার নাম কীর্তন করবে তার কলি থেকে কোনো ভয় থাকবে না। এই বলে তিনি বহেড়া গাছে প্রবেশ করলেন। কলির প্রভাব থেকে মুক্ত নলের দুঃখ দূর হল কিন্তু তখনও তিনি বিরূপ হোয়ে রইলেন।

ঋতুপর্ণ সন্ধ্যাবেলা বিদর্ভরাজের কন্ডিন নগরে প্রবেশ করলেন। নল-চালিত রথের গম্ভীর শব্দ শুনে দময়ন্তী অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয় মহারাজা নল এখানে আসছেন। আজ যদি তার চন্দ্রবদন না দেখতে পাই, যদি তাকে আলিঙ্গন করতে না পারি, তবে আমি নিশ্চয় মরবো। দময়ন্তী জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাসাদের উপরে উঠে ঋতুপর্ণ ও বাহুককে দেখতে পেলেন।

ঋতুপর্ণ স্বয়ংবরের কোনও আয়োজন দেখতে পেলেন না। বিদর্ভরাজ ভীম কিছুই জানতেন না, তিনি ঋতুপর্ণকে সংবর্ধনা করে তার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ঋতুপর্ণ দেখলেন, কোনও রাজা বা রাজপুত্র স্বয়ংবরের জন্য আসেননি। অগত্যা তিনি বিদর্ভরাজকে বললেন, আপনাকে অভিবাদন করতে এসেছি। রাজা ভীমও বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, শত যোজনের অধিক পথ অতিক্রম করে কেবল অভিবাদনের জন্য এঁর আসবার কারণ কি?

রাজার পরিচারকগণ ঋতুপর্ণকে তার জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে নিয়ে গেল, বাষ্ণেয়ও তাঁর সঙ্গে গেল। বাহুকরূপী নল রথশালায় রথ নিয়ে গিয়ে ঘোড়াদের যথাবিধি পরিচর্যা করে রথেই বসলেন। দময়ন্তী নলকে না দেখে কেশিনী নামে এক দূতীকে বললেন, তুমি জেনে এস ওই রথচালকটি কে?

দময়ন্তীর নির্দেশে কেশিনী নলের কাছে গিয়ে কুশল প্রশ্ন করে বললো, দময়ন্তী জানতে চান আপনারা অযোধ্যা থেকে কেন এখানে এসেছেন। আপনি কে, আপনাদের সঙ্গে যে তৃতীয় লোকটি এসেছে সেই বা কে? নল উত্তর দিলেন, দময়ন্তীর দ্বিতীয়বার স্বয়ংবর হবে শুনে রাজা ঋতুপর্ণ এখানে এসেছেন। আমি ঘোড়া ও রথ চালনায় দক্ষ সেজন্য রাজা আমাকে সারথি করেছেন, আমি তার ভোজনও প্রস্তুত করি। তৃতীয় লোকটির নাম বাষ্ণেয়, পূর্বে সে নলের সারথি ছিল, নল রাজ্যত্যাগ করার পর থেকে সে রাজা ঋতুপর্ণের আশ্রয়ে আছে। কেশিনী বললো, বাহুক, নল কোথায় আছেন বাষ্ণেয় কি তা জানে? নল বললেন, সে বা অন্য কেউ নলের সংবাদ জানে না, তার রূপ নষ্ট হয়েছে, তিনি আত্মগোপন করে বিচরণ করছেন। কেশিনী বললো, যে ব্রাহ্মণ অযোধ্যায় গিয়েছিলেন তার কথার উত্তরে আপনি যা বলেছিলেন দময়ন্তী পুনর্বার তা আপনার নিকট শুনতে চান। নল জলভরা চোখে রুদ্ধ স্বরে বললেন, সতী স্ত্রী বিপদে পড়লেও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করেন। পাখি যার পোশাক নিয়ে উড়ে গিয়েছিল, সেই মোহগ্রস্ত অসহায় পতি পরিত্যাগ করে চলে গেলেও সতী নারী ক্রুদ্ধ হন না।

কেশিনীর কাছে সমস্ত শুনে দময়ন্তী অনুমান করলেন, বাহুকই নল। তিনি কেশিনীকে বললেন, তুমি আবার বাহুকের কাছে গিয়ে তার আচরণ লক্ষ্য করো। তিনি চাইলেও তাঁকে জল দিও না। কেশিনী পুনর্বার গেল এবং ফিরে এসে বললো, এমন শুদ্ধাচার মানুষ আমি কখনও দেখি নি। ইনি নীচু দরজা দিয়ে প্রবেশ কালে নত হন না, দরজাই তার জন্য উঁচু হয়ে যায়। ঋতুপর্ণের ভোজনের জন্য আমাদের রাজা বিবিধ পশুমাংস পাঠিয়েছেন, মাংস ধোবার জন্য কলসও সেখানে আছে। বাহুকের দৃষ্টিপাতে কলস জলে পূর্ণ হোয়ে গেল। মাংস ধুয়ে উনানে চাপিয়ে বাহুক শুকনো কাঠ সূর্যকিরণে ধরলেন, তখনই কাঠে আগুন ধরে গেল। তিনি আগুন স্পর্শ করলে পুড়ে যান না, ফুল পিষলেও তা বিকৃত হয় না, আরও সুগন্ধ ও বিকশিত হয়। দময়ন্তী বললেন, কেশিনী, তুমি আবার যাও, তাকে না জানিয়ে তার রাঁধা মাংস কিছু নিয়ে এসো। কেশিনী মাংস আনলে দময়ন্তী তা চেখে বুঝলেন যে নলই তা রেঁধেছেন। তখন তিনি তাঁর পুত্রকন্যাকে কেশিনীর সঙ্গে বাহুকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। নল ইন্দ্রসেন ও ইন্দ্রসেনাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার পর কেশিনীকে বললেন, এই বালক-বালিকা আমার পুত্র-কন্যার সদৃশ সেজন্য আমি কাঁদছি। ভদ্রে, আমরা অন্য দেশের অতিথি, তুমি বার বার এলে লোকে দোষ দেবে, অতএব তুমি যাও।

দময়ন্তী তার মাকে বললেন, আমি বহু পরীক্ষায় বুঝেছি যে বাহুকই নল, কেবল তার রূপের জন্য আমার সংশয় আছে। এখন আমি নিজেই তাকে দেখতে চাই, আপনি পিতাকে জানিয়ে বা না জানিয়ে আমাকে অনুমতি দিন। পিতা মাতার সম্মতিক্রমে দময়ন্তী নলকে তার গৃহে আনালেন। নল এলে দময়ন্তী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বাহুক, ঘুমন্ত পত্নীকে বনে পরিত্যাগ করে চলে গেছেন এমন কোনও ধর্মজ্ঞ পুরুষকে জান কি? মহারাজা নল ভিন্ন আর কে সন্তানবতী পতিব্রতা স্ত্রীকে বিনা দোষে ত্যাগ করতে পারে? নল বললেন, যার জন্য আমার রাজ্য নষ্ট হয়েছে সেই কলির প্রভাবেই আমি তোমাকে ত্যাগ করেছিলাম। তোমার অভিশাপে দগ্ধ হয়ে কলি আমার দেহে বাস করছিল, এখন আমি তাকে জয় করেছি, সেই পাপ দূর হয়েছে। কিন্তু তুমি দ্বিতীয় পতি বরণে ইচ্ছুক হয়েছ কেন? দময়ন্তী বললেন, নিষধরাজ, আমার দোষ দিতে পার না, দেবগণকে বর্জন করে আমি তোমাকেই পতিত্বে বরণ করেছিলাম। তোমার অন্বেষণে আমি সর্বত্র লোক পাঠিয়েছিলাম। ব্রাহ্মণ পর্ণাদের মুখে তোমার কথা শুনেই তোমাকে আনাবার জন্য আমি এই উপায় অবলম্বন করেছি।

অন্তরীক্ষ থেকে বায়ু বললেন, নল, এঁর কোনও পাপ নেই, আমরা তিন বৎসর এঁর সাক্ষী ও রক্ষী হয়ে আছি। তুমি ভিন্ন কেউ একদিনে শত যোজন পথ অতিক্রম করতে পারে না, তোমাকে আনাবার জন্যই ইনি অসাধারণ উপায় স্থির করেছিলেন। তখন পুষ্পবৃষ্টি হল, দুন্দুভি বাজতে লাগল। নাগরাজ কর্কোটকের দেওয়া বস্ত্র পরে নল তার পূর্বরূপ ফিরে পেলেন, দময়ন্তী তাঁকে আলিঙ্গন করে কাঁদতে লাগলেন।

পরদিন প্রভাতে নল সুসজ্জিত হয়ে দময়ন্তীর সঙ্গে শ্বশুর ভীম রাজার কাছে গিয়ে অভিবাদন করলেন, ভীমও পরম আনন্দে নলকে পুত্রের ন্যায় গ্রহণ করলেন। রাজধানী সুসজ্জিত করা হোলো, নগরবাসীরা আনন্দ করতে লাগল। ঋতুপর্ণ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে নলকে বললেন, নিষধরাজ, ভাগ্যক্রমে আপনি পত্নীর সঙ্গে পুনর্মিলিত হলেন। আমার গৃহে আপনার অজ্ঞাত-বাসকালে যদি আমি কোনও অপরাধ করে থাকি তো ক্ষমা করুন। নল বললেন, মহারাজ, আপনি কিছুমাত্র অপরাধ করেননি, আপনি পূর্বে আমার বন্ধু ও আত্মীয় ছিলেন, এখন আরও প্রীতিভাজন হলেন। তার পর ঋতুপর্ণ মহারাজা ভীম ও নলের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে স্বরাজ্যে প্রস্থান করলেন।

এক মাস পরে নল সসৈন্যে নিজ রাজ্যে প্রবেশ করে পুষ্করকে বললেন, আমি বহু ধন উপার্জন করেছি, পুনর্বার পাশা খেলবো। আমার সমস্ত ধন ও দময়ন্তীকে পণ রাখছি, তুমি রাজ্য পণ রাখো। যদি পাশা খেলায় অসম্মত হও তবে আমার সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ করো। পুষ্কর বললেন, ভাগ্যক্রমে আপনি আবার এসেছেন, আমি আপনার ধন জয় করে নেবো, সুন্দরী দময়ন্তীও আমার সেবা করবেন। নলের ইচ্ছা হল তিনি পুষ্করের শিরচ্ছেদ করেন, কিন্তু ক্রোধ সংবরণ করে বললেন, এখন কথা বলে লাভ কি, আগে জয়ী হও তার পর বলো।

পাশা খেলার শুরুতে এক বাজীতেই নল পুষ্করের সর্বস্ব জয় করলেন। তিনি বললেন, মূর্খ, তুমি দময়ন্তীকে পেলে না, নিজেই সপরিবারে তার দাস হলে। আমার পূর্বের পরাজয় কলির প্রভাবে হয়েছিল, তোমার তাতে কৃতিত্ব ছিলো না। পরের দোষ তোমাতে আরোপ করবো না, তুমি আমার ভাই, আমার রাজ্যের এক অংশ তোমাকে দিলাম। তোমার প্রতি আমার স্নেহ কখনও নষ্ট হবে না, তুমি শত বৎসর জীবিত থাকো। এই বলে নল ভাইকে আলিঙ্গন করলেন। নলকে প্রণাম কোরে হাতজোড় কোরে পুষ্কর বললেন, মহারাজ, আপনার কীর্তি অক্ষয় হোক, আপনি আমাকে প্রাণ ও রাজ্য দান করলেন, আপনি অযুত বৎসর জীবিত থাকুন।

নলের কাহিনি শেষ করে বৃহদশ্ব বললেন, যুধিষ্ঠির, নল রাজা পাশা খেলার ফলে স্ত্রীর সঙ্গে এইরূপ দুঃখভোগ করেছিলেন, পরে আবার সমৃদ্ধিলাভও করেছিলেন। কর্কোটক নাগ, নল-দময়ন্তী আর রাজর্ষি ঋতুপর্ণের ইতিহাস শুনলে কলির ভয় দূর হয়। তুমি আশ্বস্ত হও, বিষাদগ্রস্ত হয়ো না। তোমার ভয় আছে, আবার কেউ পাশা খেলায় তোমাকে আহ্বান করবে। এই ভয় আমি দূর করছি। আমি দক্ষতার সঙ্গে পাশা খেলার মন্ত্রগুপ্তি জানি, তুমি তা শিখে নাও। এই বলে বৃহদশ্ব যুধিষ্ঠিরকে দক্ষতার সঙ্গে পাশা খেলার মন্ত্রগুপ্তি শিখিয়ে তীর্থভ্রমণে চলে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)