Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 48

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪৮

মহর্ষি লোমশ বর্ণিত মহর্ষি চ্যবনের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি লোমশ বর্ণিত মহর্ষি চ্যবনের কাহিনি

মহেন্দ্র পর্বতে পরশুরামের আশ্রম থেকে বেরিয়ে পাণ্ডবগণ গোদাবরী নদী, দ্রাবিড় দেশ, অগস্ত্য তীর্থ, সূপারক তীর্থ প্রভৃতি দর্শন কোরে প্রভাসতীর্থে উপস্থিত হলেন। তাদের আসবার খবর পেয়ে বলরাম ও কৃষ্ণ সবান্ধবে পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। পাণ্ডবগণ মাটিতে শয়ন করেন, তাদের শরীর মলিন এবং তাদের পত্নী দ্রৌপদীও কষ্টভোগ করছেন দেখে সকলে অতিশয় দুঃখিত হলেন। বলরাম, কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, সাত্যকি প্রভৃতি বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ যুধিষ্ঠির কর্তৃক সম্মানিত হোয়ে তাকে ঘিরে উপবেশন করলেন।

আসন গ্রহণ করবার পর বলরাম বললেন, ধর্মাচরণ করলেই মঙ্গল হয় না, অধর্ম করলেই অমঙ্গল হয় না। মহাত্মা যুধিষ্ঠির জটা ও ছিন্নবস্ত্র ধারণ করে বনবাসী হয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, আর দুর্যোধন পৃথিবী শাসন করছেন, এই দেখে অল্পবুদ্ধি লোকে মনে করবে ধর্মের চেয়ে অধর্মই ভালো। ভীষ্ম, কৃপ, দ্রোণ, ও ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক, পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়ে তারা কি সুখ পাচ্ছেন? ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের নির্বাসন আর দুর্যোধনের বৃদ্ধি দেখে পৃথিবী বিদীর্ণ হচ্ছে না কেন?

সাত্যকি বললেন, এখন বিলাপের সময় নয়, যুধিষ্ঠির কিছু না বললেও আমাদের যা কর্তব্য তা করবো। আমরা ত্রিলোক জয় করতে পারি, বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধক প্রভৃতি যদুবংশের বীরগণ আজই সসৈন্য যাত্রা করে দুর্যোধনকে যমালয়ে পাঠান। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির তার প্রতিজ্ঞা পালন করুন, তার বনবাসের কাল সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিমন্যু রাজ্য শাসন করবে।

কৃষ্ণ বললেন, সাত্যকি, আমরা তোমার মতে চলতাম, কিন্তু যা নিজের বিক্রমে জয় করা সম্ভব হয়নি, এমন রাজ্য যুধিষ্ঠির চান না। ইনি, এঁর ভাইয়েরা, এবং দ্রুপদকন্যা, কেউ স্বধর্ম ত্যাগ করবেন না।

যুধিষ্ঠির বললেন, সত্য সর্বদা রক্ষা করা কর্তব্য, রাজ্য রক্ষা করার জন্য সত্যভ্রষ্ট হওয়া উচিৎ নয়। একমাত্র কৃষ্ণই আমাকে যথার্থভাবে জানেন, আমিও তাঁকে জানি। সাত্যকি, পুরুষশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ যখন মনে করবেন যে বলপ্রকাশের সময় এসেছে তখন তোমরা দুর্যোধনকে জয় কোরো।

যাদবগণ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। যুধিষ্ঠিরাদি পুনর্বার যাত্রা করে নর্মদার নিকটে বৈদূর্য পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে উপস্থিত হোয়ে লোমশ মুনি বললেন - মহর্ষি ভৃগুর পুত্র চ্যবন এই স্থানে দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন, তাঁর দেহ উঁইপোকার ঢিপি, পিপীলিকা ও লতায় ঢেকে যায়। একদিন রাজা শর্ষাতি এখানে ভ্রমণ করতে এলেন, তার চার হাজার স্ত্রী এবং সুকন্যা নামে এক রূপবতী কন্যা ছিল। সুকন্যাকে সেই মনোরম স্থানে বিচরণ করতে দেখে চ্যবন আনন্দিত হয়ে ক্ষীণকণ্ঠে তাকে ডাকলেন। সুকন্যা শুনতে পেলেন না, তিনি উঁইপোকার ঢিপির ভিতরে চ্যবনের দুটি উজ্জ্বল চোখ দেখতে পেয়ে বললেন, একি! তার পর কৌতূহল বশে চ্যবনের চোখ কাঁটা দিয়ে বিদ্ধ করলেন। চ্যাবন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শর্ষাতির সৈন্যদের মলমূত্র বন্ধ করলেন। সৈন্যদের কষ্ট দেখে রাজা সকলকে জিজ্ঞাসা করলেন, বৃদ্ধ রাগী চ্যবন ঋষি এখানে তপস্যা করেন, কেউ তার ক্ষতি করেনি তো? সুকন্যা বললেন, উঁইপোকার ঢিপির ভিতরে উজ্জ্বল দুটি বস্তু রয়েছে দেখে আমি কাঁটা দিয়ে বিদ্ধ করেছি। শর্যাতি তখনই চ্যবনের কাছে গিয়ে হাত জোড় কোরে বললেন, আমার বালিকা কন্যা অজ্ঞানতার বশে আপনাকে কষ্ট দিয়েছে, দয়া কোরে ক্ষমা করুন। চ্যবন বললেন, রাজা, তোমার কন্যা অহঙ্কার ও অবজ্ঞার বশে আমার চোখ বিদ্ধ করেছে, তাকে যদি আমার সঙ্গে বিবাহ দাও তবে ক্ষমা করবো। শর্যাতি রাজী হোয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই তার কন্যাকে চ্যবনের সঙ্গে বিবাহ দিলেন।

সুকন্যা সযত্নে চ্যবনের সেবা করতে লাগলেন। একদিন অশ্বিনীকুমারদ্বয় সুকন্যাকে স্নানের পর নগ্ন অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাঁকে বললেন, তোমার ন্যায় সুন্দরী দেবতাদের মধ্যেও নেই। তোমার পিতা তোমাকে বৃদ্ধ মুনির সঙ্গে বিবাহ দিয়েছেন কেন? তুমি জরাগ্রস্ত অক্ষম চ্যবনকে ত্যাগ করে আমাদের একজনকে বরণ করো। সুকন্যা বললেন, আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি। অশ্বিনীকুমারদ্বয় বললেন, আমরা দেবচিকিৎসক, তোমার পতিকে যুবক ও রূপবান করে দেবো, তার পর তিনি এবং আমরা এই তিন জনের মধ্যে একজনকে তুমি পতিত্বে বরণ কোরো। সুকন্যা চ্যবনকে জানালে তিনি এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। তখন অশ্বিনীকুমারদ্বয় চ্যবনকে নিয়ে জলে ডুব দিলেন এবং একটু পরে তিন জনেই একই রকম সুন্দর রূপ ও বেশ ধারণ করে জল থেকে উঠলেন। সকলে দেখতে এক রকম হলেও সুকন্যা চ্যবনকে চিনতে পেরে তাকেই বরণ করলেন। চ্যবন খশি হয়ে অশ্বিনীদ্বয়কে বললেন, আপনারা আমাকে রূপবান যুবক করেছেন, আমি এই স্ত্রীকেও পেয়েছি। আমি দেবরাজের সামনেই আপনাদেরকে সোমরসপায়ী করবো।

চ্যবনের অনুরোধে রাজা শর্ষাতি এক যজ্ঞ করলেন। চ্যবন যখন অশ্বিনীদ্বয়কে দেবার জন্য সোমরসের পাত্র নিলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাকে বারণ করে বললেন, এঁরা দেবতাদের চিকিৎসক ও কর্মচারী মাত্র, এরা মর্ত্যলোকেও বিচরণ করেন, তাই এঁরা সোমরস পানের অধিকারী নন। চ্যবন ইন্দ্রের বারণ না মেনে, ঈষৎ হেসে অশ্বিনীদ্বয়ের জন্য সোমরসের পাত্র তুলে নিলেন। ইন্দ্র তখন বজ্র দিয়ে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। চ্যবন ইন্দ্রের বাহু অবশ কোরে মন্ত্রপাঠ করে আগুনে আহুতি দিলে, আগুন থেকে মদ নামক এক মহাকায় ঘোরদর্শন দেবতা উঠে এসে ইন্দ্রকে গ্রাস করতে গেলো। ভীষণ ভয়ে ইন্দ্র চ্যবনকে বললেন, ব্রহ্মর্ষি, প্রসন্ন হন, আজ থেকে দুই অশ্বিনীকুমারও সোমরস পানের অধিকারী হবেন। চ্যবন প্রসন্ন হয়ে ইন্দ্রের অবশ বাহুদ্বয় মুক্ত করলেন। শর্ষাতির যজ্ঞ সমাপ্ত হোলো আর চ্যবন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বনে চলে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)