Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 49

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪৯

মহর্ষি লোমশ বর্ণিত মান্ধাতা, সোমক ও জন্তুর কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি লোমশ বর্ণিত মান্ধাতা, সোমক ও জন্তুর কাহিনি

মহর্ষি চ্যবনের কাহিনি শোনার পর পাণ্ডবগণ নানা তীর্থ দর্শন করে যমুনা নদীর তীরে উপস্থিত হলেন। সেখানে পৌঁছে লোমশ মুনি পাণ্ডবদেরকে বললেন রাজা মান্ধাতা ও সোমক এই জায়গায় যজ্ঞ করেছিলেন। আমি তাদের কাহিনি বর্ণনা করছি, শোনো -

ইক্ষ্বাকুবংশে যুবনাশ্ব নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি মন্ত্রীদের উপর রাজ্যভার দিয়ে বনে গিয়ে সন্তান কামনায় যোগসাধনা করতে লাগলেন। একদিন তিনি ক্লান্ত ও পিপাসার্ত হয়ে চ্যবন মুনির আশ্রমে প্রবেশ কোরে দেখলেন যজ্ঞবেদীর উপর এক কলস জল রয়েছে। যুবনাশ্ব জল চাইলেন, কিন্তু তার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর কেউ শুনতে পেলেন না। তখন তিনি জলপান করে অবশিষ্ট জল কলস থেকে ফেলে দিলেন। মহর্ষি চ্যবন ও অন্যান্য মুনিরা নিদ্রা থেকে উঠে দেখলেন, কলস জলশূন্য। কলস জলশূন্য দেখে খোঁজ নিয়ে মহর্ষি চ্যবন যুবনাশ্বের কাছে জানতে পারলেন যে, তিনিই তৃষ্ণার্ত হোয়ে কলস থেকে কিছুটা জল পান কোরে বাকি জল ফেলে দিয়েছেন। যুবনাশ্বের স্বীকারোক্তি শুনে চ্যবন বললেন, রাজা, আপনি অনুচিত কাজ করেছেন, আপনার যাতে পুত্র প্রাপ্তি হয় সেইজন্য এই মন্ত্রপূতঃ জল রেখেছিলাম। এই জলপান করার ফলে আপনিই পুত্র প্রসব করবেন কিন্তু আপনি গর্ভধারণের কষ্ট অনুভব করবেন না। কিছুকাল পরে যুবনাশ্বের পেটের বাম পাশ ভেদ করে এক সূর্যতুল্য তেজস্বী পুত্রের জন্ম হোলো। দেবতারা শিশুকে দেখতে এলেন। তারা বললেন, মাতৃগর্ভে না জন্মানো এই শিশু কি পান করবে? ‘মাং স্যতি’ - আমাকে পান করবে — এই বলে ইন্দ্র তার মুখে নিজের তর্জনী ঢুকিয়ে দিলে সে চুষতে লাগল। এই শিশুর নাম হোলো মান্ধাতা। মান্ধাতা বড় হয়ে ধনুর্বেদে পারদর্শী এবং বিবিধ দিব্যাস্ত্র ও অভেদ্য কবচের অধিকারী হলেন। স্বয়ং ইন্দ্র তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। মান্ধাতা ত্রিভুবন জয় কোরে এবং বহু যজ্ঞ করে ইন্দ্রের অর্ধার্সন লাভ করেছিলেন।

সোমক রাজার একশত স্ত্রী ছিলো। বৃদ্ধ বয়সে জন্তু নামে তাঁর একটি মাত্র পুত্র হোলো। সোমকের সমস্ত পত্নী সর্বদা তাকে সযত্নে ঘিরে থাকতেন। একদিন সেই বালক পিপীলিকার দংশনে কেঁদে উঠলে তার মায়েরাও কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাজা সোমক সেই কান্নার আওয়াজ শুনে অন্তঃপুরে এসে পুত্রকে শান্ত করলেন। তারপর তিনি তাঁর পুরোহিত ও মন্ত্রিবর্গকে বললেন, এক পুত্রের চেয়ে পুত্র না থাকাই ভালো। এক পুত্র থাকলে সব সময় উদ্বেগ হয়। অমি পুত্র লাভের আশায় শত পত্নীর পাণিগ্রহণ করেছি, কিন্তু শুধু একটি পুত্র হয়েছে, এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে। আমার ও পত্নীদের যৌবন অতীত হয়েছে, আমরা প্রাণ ধারণ কোরে আছি শুধুমাত্র একটিমাত্র বালককে আশ্রয় করে। এমন উপায় কি কিছু নেই যাতে আমার শত পুত্র হোতে পারে?

সোমকের প্রশ্নের উত্তরে পুরোহিত বললেন, আমি এক যজ্ঞ করব, তাতে যদি আপনি আপনার পুত্র জন্তুকে আহুতি দেন তবে শীঘ্ৰ শত পুত্র লাভ করবেন। জন্তুকে আহুতি দিলেও সে আবার তার মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করবে এবং তার বাম পাশে একটি সোনালি চিহ্ন থাকবে। রাজা সম্মত হোলে পুরোহিত যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, রাজপত্নীরা জন্তুর হাত ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। যাজক (পুরোহিত) তখন বালককে সবলে টেনে নিয়ে কেটে ফেললেন এবং তার শরীর থেকে চর্বি নিয়ে আগুনে আহুতি দিয়ে যথাবিধি হোম করলেন। তার গন্ধ আঘ্রাণ করে সোমকের পত্নীরা শোকার্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন এবং সকলেই গর্ভবতী হলেন। যথাকালে সোমক শত পুত্র লাভ করলেন। জন্তু সোনালি চিহ্ন ধারণ করে তার আগের মায়ের গর্ভ থেকেই ভূমিষ্ট হোলো।

কিছুকাল পর সেই যাজক ও সোমক দুজনেই পরলোকে গেলেন। পরলোকে গিয়ে যাজককে নরকভোগ করতে দেখে সোমক তাঁকে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। যাজক বললেন, আমি আপনার জন্য যে আপনার সন্তানকে আগুনে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ করেছিলাম, তার জন্যই এই ফল। তখন সোমক ধর্মরাজ যমকে বললেন, যাজককে মুক্তি দিন, এঁর পরিবর্তে আমিই নরকভোগ করবো। যম বললেন, রাজা, একজনের পাপের ফল অন্যে ভোগ করতে পারে না। সোমক বললেন, এই ব্রহ্মবাদী যাজককে ছেড়ে আমি পুণ্যফল ভোগ করতে চাই না, এঁর সঙ্গেই আমি স্বর্গে বা নরকে বাস করবো। আমরা একই কর্ম করেছি, আমাদের পাপপুণ্যের ফল সমান হোক। তখন যমের সম্মতিক্রমে যাজকের সঙ্গে সোমকও নরকভোগ করলেন এবং পাপক্ষয় হলে দুজনেই মুক্ত হয়ে স্বর্গলোক লাভ করলেন।

______________

(ক্রমশ)