Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 59

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৫৯

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় কর্তৃক বৈবস্বত মনু, মৎস্য ও বালকরূপী নারায়ণের কাহিনি বর্ণন

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় কর্তৃক বৈবস্বত মনু, মৎস্য ও বালকরূপী নারায়ণের কাহিনি বর্ণন

মহর্ষি অরিষ্টনেমি এবং মহর্ষি অত্রির কাহিনি বর্ণনা করার পরে যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বৈবস্বত মনুর কাহিনি বললেন –

বিবস্বানের (সূর্যের) পুত্র মনু রাজ্যলাভের পর বদরিকাশ্রমে গিয়ে দশ হাজার বৎসর কঠোর তপস্যা করেছিলেন। একদিন একটি ক্ষুদ্র মৎস্য চীরিণী নদীর তীরে এসে মনুকে বললে, বলবান বৃহৎ মৎস্যদের আক্রমণ থেকে আমাকে রক্ষা করুন। মনু সেই মৎস্যটিকে একটি জালার মধ্যে রাখলেন। ক্রমশ সে বড় হলে মনু তাকে একটি বিশাল পুকুরে রাখলেন। কিছুদিনের মধ্যে সেই মৎস্য এত বড় হোলো যে সেখানেও তার স্থান হোলো না, তখন মনু তাকে গঙ্গায় ছেড়ে দিলেন। কিছুকাল পরে মৎস্য মনুকে বললো, প্রভু, আমি আকারে এত বিশাল হয়েছি যে গঙ্গায় নড়তে পারছি না, আমাকে দয়া কোরে সমুদ্রে ছেড়ে দিন। মনু যখন তাকে সমুদ্রে ফেললেন তখন সেই মৎস্য বললো, আপনি আমাকে সর্বত্র রক্ষা করেছেন, এখন আপনার যা কর্তব্য তা শুনুন।

“প্রলয়কাল আসন্ন তাই স্থাবর জঙ্গম সমস্তই জলমগ্ন হবে। আপনি একটি বিশাল নৌকা প্রস্তুত করিয়ে মজবুত দড়ি দিয়ে দৃঢ়ভাবে বেঁধে সপ্তর্ষিদের সঙ্গে তাতে উঠবেন, এবং পূর্বে ব্রাহ্মণগণ যেসকল বীজের কথা বলেছেন তাও ওই নৌকায় রাখবেন। আপনি সেই নৌকায় থেকে আমার প্রতীক্ষা করবেন, আমি বিশাল শিং ধারণ করে আপনার কাছে আসবো। মৎস্যের উপদেশ অনুসারে মনু নৌকা বানিয়ে মহাসমুদ্রে সেই নৌকায় উঠলেন। তিনি স্মরণ করা মাত্র সেই মৎস্য উপস্থিত হল। মনু তার শিং-এর সঙ্গে দড়ি বাঁধলে, মৎস্য ভয়ঙ্কর শব্দে উত্তাল ঢেউয়ে বয়ে চলা সমুদ্রের উপর দিয়ে মহাবেগে নৌকা টেনে নিয়ে চলল। তখন পৃথিবী, আকাশ ও সমস্ত দিক জলময়, কেবল সাতজন ঋষি, মনু আর মৎস্যকে দেখা যাচ্ছিল। বহু বছর পরে হিমালয়ের নিকটে এসে মনু মৎস্যের উপদেশ অনুসারে পর্বতের উচ্চতম শৃঙ্গে নৌকা বাঁধলেন। সেই শৃঙ্গ এখনও ‘নৌবন্ধন’ নামে বিখ্যাত। তার পর মৎস্য ঋষিগণকে বললো, আমি প্রজাপতি ব্রহ্মা, আমার উপরে কেউ নেই, আমি মৎস্যরূপে তোমাদের ভয়মুক্ত করেছি। এই মনু দেবাসুর, মানুষ প্রভৃতি সকল প্রজা ও স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি করবেন। এই বলে মৎস্য চলে গেল। তার পর মনু কঠোর তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে সকল প্রজা সৃষ্টি করতে লাগলেন।”

তার পর যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়কে অনুরোধ কোরে বললেন, আপনি পুরাকালের সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তার সম্বন্ধে আপনি কিছু আমাদেরকে বলুন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় বললেন, সত্যযুগের পরিমাণ চার হাজার বছর, তার সন্ধ্যা চার শত বছর, এবং সন্ধ্যাংশ চার শত বছর। ত্রেতাযুগ তিন হাজার বছর, তার সন্ধ্যা তিন শ বৎসর, সন্ধ্যাংশও তাই। দ্বাপরযুগ দুই হাজার বছর, সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ দুইই দুই শত বছর। কলিযুগ এক হাজার বছর, সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ এক-এক শত বছর। চার যুগে বারো হাজার বছর। এক হাজার যুগে ব্রহ্মার এক দিন। তার পর ব্রহ্মার রাত্রি প্রলয়কাল। একদিন  প্রলয়কালে আমি নিরাশ্রয় হয়ে সমুদ্রজলে ভাসছিলাম, এমন সময়ে দেখলাম, এক বিশাল বটগাছের শাখার তলে সুসজ্জিত পালঙ্কের উপর এক অপরূপ সুন্দর বালক শুয়ে আছে, তার গাত্রবর্ণ অতসী ফুলের মতো নীল, বুকে শ্রীবৎসচিহ্ন। সেই বালক আমাকে বললো, বৎস মার্কণ্ডেয়, তুমি পরিশ্রান্ত হয়েছ, আমার শরীরের ভিতরে প্রবেশ কোরে বিশ্রাম করো। এই বলে তিনি তাঁর মুখ হাঁ করলে আমি তার পেটের মধ্যে প্রবেশ করে দেখলাম, নগর, রাষ্ট্র, পর্বত, নদী, সাগর, আকাশ, চন্দ্রসূর্য, দেবগণ, অসুরগণ সমেত সমগ্র জগৎ সেখানে রয়েছে। এক শত বছরের অধিক কাল তাঁর দেহের মধ্যে বিচরণ করে কোথাও তার সীমা দেখতে পেলাম না, তখন আমি সেই বালকের শরণ নিলাম এবং সহসা তাঁর খোলা মুখ থেকে দ্রুতবেগে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে দেখলাম, সেই দ্যুতিমান বালক বটবৃক্ষের শাখায় বসে আছেন। তিনি সহাস্যে বললেন, মার্কণ্ডেয়, তুমি আমার শরীরে সুখে বাস করেছ তো?

আমি নবদৃষ্টি লাভ কোরে মোহমুক্ত হয়ে তার সুন্দর কোমল রক্তিম চরণদ্বয় মস্তকে ধারণ করলাম। তার পর হাত জোড় কোরে বললাম, প্রভু, তোমাকে আর তোমার মায়াকে জানতে ইচ্ছা করি। সেই বালক বললেন, পুরাকালে আমি জলের নাম

‘নারা’ দিয়েছিলাম, প্রলয়কালে সেই জলই আমার অয়ন বা আশ্রয় হওয়ার জন্য আমি নারায়ণ। আমি তোমার উপর তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মার রূপ ধারণ কোরে অনেক বার তোমাকে বর দিয়েছি। লোকপিতামহ ব্রহ্মা আমার শরীরের অর্ধাংশ। যত কাল তিনি নিদ্রিত থাকেন তত কাল আমি শিশুরূপে এইখানে থাকি। প্রলয় শেষে ব্রহ্মা আবার জেগে উঠলে আমি তার সঙ্গে মিশে গিয়ে আকাশ, পৃথিবী, স্থাবর, জঙ্গম প্রভৃতি সৃষ্টি করবো। তত কাল তুমি সুখে এখানে বাস করো। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন।

এই কাহিনি শেষ করে মার্কণ্ডেয় যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, সেই প্রলয়কালে আমি যে পদ্মলোচন আশ্চর্য বালককে দেখেছিলাম, তিনিই তোমার এই পরমাত্মীয় কৃষ্ণ। এঁর বরে আমার স্মৃতি নষ্ট হয় না, আমি দীর্ঘায়ু এবং ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী হয়েছি। তোমরা এঁর শরণ নাও। মার্কণ্ডেয় এইরূপ বললে পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী কৃষ্ণকে নমস্কার করলেন।

______________

(ক্রমশ)