মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬০
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত পরীক্ষিৎ, মণ্ডুকরাজকন্যা, শল, দল ও বামদেবের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত পরীক্ষিৎ, মণ্ডুকরাজকন্যা, শল, দল ও বামদেবের কাহিনি
বৈবস্বত মনু, মত্স্য প্রভৃতির কাহিনি শোনার পর যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় ব্রাহ্মণমাহাত্ম্য বিষয়ক আরও কাহিনি বললেন - অযোধ্যায় পরীক্ষিৎ নামে ইক্ষ্বাকুবংশীয় এক রাজা ছিলেন। একদিন তিনি ঘোড়ায় চড়ে মৃগয়ায় গিয়ে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে গভীর বনের মধ্যে এক সরোবর দেখতে পেলেন। রাজা স্নান করে সরোবরের তীরে বসলেন। তিনি দেখলেন, বনের মধ্যে এক পরমা সুন্দরী কন্যা ফুল তুলতে তুলতে গান করছে। রাজা বললেন, হে সুন্দরী, তুমি কে? আমি তোমাকে বিবাহ করতে চাই। কন্যা বললো, আমার নাম সুশোভনা, যদি প্রতিজ্ঞা কর যে আমাকে কখনও জল দেখাবে না তবেই তোমাকে বিবাহ করতে পারি। রাজা সম্মত হলেন এবং সেই কন্যাকে বিবাহ করে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে পত্নীর সঙ্গে নির্জন স্থানে বাস করতে লাগলেন।
পরিচারিকাদের কাছে সেই কন্যার বৃত্তান্ত শুনে রাজমন্ত্রী নানা গাছপালায় শোভিত এক উদ্যান রচনা করলেন। সেই উদ্যানের এক পাশে একটি পুকুর ছিল, তার জল মুক্তাজাল দিয়ে ঢেকে রাখা হোলো। মন্ত্রী রাজাকে বললেন, এই মনোরম উদ্যানে জল নেই, আপনি এখানে বিহার করুন। রাজা তার পত্নীর সঙ্গে সেখানে বাস করতে লাগলেন। একদিন তারা বেড়াতে বেড়াতে শ্রান্ত হয়ে সেই পুকুরের তীরে এলেন। রাজা পূর্বশর্ত ভুলে গিয়ে রানীকে বললেন, তুমি জলে নামো। রাজার কথায় রানী জলে নামলেন, কিন্তু আর উঠলেন না। রাজা তখন সেই পুকুর জলশূন্য করালেন এবং তার মধ্যে অনেকগুলি মণ্ডুক (ব্যাং) দেখে আজ্ঞা দিলেন, সমস্ত মণ্ডুক মেরে ফেলো। রাজার নির্দেশ শুনে মণ্ডুকরাজ তপস্বীর বেশে রাজার কাছে এসে বললেন, মহারাজ, বিনা দোষে মণ্ডুক হত্যা করবেন না। রাজা বললেন, এই দুরাত্মারা আমার পত্নীকে খেয়ে ফেলেছে। মণ্ডুকরাজ নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার নাম আয়ু, আপনার পত্নী আমার কন্যা সুশোভনা। তার দুষ্ট স্বভাবের জন্য অনেক রাজাকে ইতিপূর্বে প্রতারণা করেছে। রাজার প্রার্থনায় আয়ু তার কন্যাকে এনে দিলেন এবং তার কন্যাকে অভিশাপ দিলেন, তোমার অপরাধের ফলে তোমার সন্তান ব্রাহ্মণের অনিষ্টকারী হবে।
সুশোভনার গর্ভে পরীক্ষিতের শল, দল ও বল নামে তিন পুত্রের জন্ম হোলো। যথাকালে শলকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে পরীক্ষিৎ বনে চলে গেলেন। একদিন শল রথে চড়ে মৃগয়ায় গিয়ে একটি দ্রুতগামী হরিণকে ধরতে পারলেন না। সারথি বললো, এই রথে যদি বামী নামক দুটি ঘোড়া জুড়ে নেওয়া হয় তবেই হরিণকে ধরতে পারবেন। মহর্ষি বামদেবের সেই ঘোড়া আছে জেনে রাজা তার আশ্রমে গিয়ে ঘোড়া প্রার্থনা করলেন। বামদেব বললেন, ঘোড়া নিয়ে যাও, কিন্তু কৃতকার্য হলেই শীঘ্র ফিরিয়ে দিও। রাজা সেই দুটি ঘোড়া রথে জুড়ে নিয়ে হরিণকে ধরলেন, কিন্তু রাজধানীতে ফিরে গিয়ে ঘোড়া ফেরত পাঠালেন না। বামদেব তাঁর শিষ্য আত্রেয়কে রাজার কাছে পাঠালে রাজা বললেন, এই ঘোড়া দুটি রাজার যোগ্য, ব্রাহ্মণের ঘোড়ার কি প্রয়োজন? তার পর বামদেব স্বয়ং এসে ঘোড়া চাইলেন। রাজা বললেন মহর্ষি, সুশিক্ষিত বলদ ব্রাহ্মণের উপযুক্ত বাহন। শল রাজা যখন কিছুতেই ঘোড়া দুটি ফেরত দিলেন না, তখন বামদেবের আদেশে চারজন ভয়ঙ্কর রাক্ষস আবির্ভূত হয়ে শূল দিয়ে রাজাকে মারতে গেল। রাজা উচ্চস্বরে বললেন, ইক্ষাকুবংশীয়গণ, আমার ভাই দল এবং সভার সমস্ত বৈশ্যগণ যদি আমার শুভাকাঙ্খী হন তবে এই রাক্ষসদের নিরস্ত করুন, বামদেব ধর্মশীল নন। এইরূপ বলতে বলতেই শল রাক্ষসদের হাতে নিহত হলেন।
শল নিহত হওয়ার পর ইক্ষাকুবংশীয়গণ তার ছোটো ভাই দলকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। তখন বামদেব তাঁর কাছে ঘোড়া চাইলে দল ক্রুদ্ধ হয়ে তার সারথিকে বললেন, আমার যে বিষাক্ত বিচিত্র বাণ আছে তারই একটা নিয়ে এস, বামদেবকে হত্যা করে তার মাংস কুকুরকে খাওয়াবো। বামদেব বললেন, রাজা, সেনজিৎ নামে তোমার যে দশ বছর বয়সের পুত্র আছে তাকেই তোমার বাণ বধ করুক। বামদেব কথা শেষ করতেই দলের বাণ অন্তঃপুরে গিয়ে রাজপুত্রকে হত্যা করলো। রাজা আর একটা বাণ আনতে বললেন, কিন্তু তার হাত বামদেবের শাপে অবশ হয়ে গেল। রাজা বললেন, সকলে দেখুন, বামদেব আমাকে অবশ করেছেন, আমি তাকে বাণ মারতে পারছি না, অতএব আমি প্রার্থনা করছি তিনি দীর্ঘায়ু হয়ে জীবিত থাকুন। বামদেব বললেন, রাজা, তোমার পত্নীকে বাণ দিয়ে স্পর্শ করো, তা হোলে তুমি পাপমুক্ত হবে। বামদেবের কথায় রাজা দল তার পত্নীকে বাণ দিয়ে স্পর্শ করলে রাজার পত্নী বললেন, এই নৃশংস রাজাকে আমি প্রতিদিন সদুপদেশ দিই, ব্রাহ্মণগণকেও সত্য ও প্রিয় বাক্য বলি, তার ফলে আমি পুণ্যলোক লাভ করবো। রাজার পত্নীর উপর তুষ্ট হয়ে বামদেব বর দিলেন, তার ফলে দল পাপমুক্ত হয়ে আশীর্বাদ লাভ করলেন এবং বামদেবকে ঘোড়া ফিরিয়ে দিলেন।
______________
(ক্রমশ)