মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬৬
দুর্যোধনের গোপপল্লী যাত্রা ও গন্ধর্বদের হাতে নিগ্রহের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
দুর্যোধনের গোপপল্লী যাত্রা ও গন্ধর্বদের হাতে নিগ্রহের কাহিনি
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবগণকে বিভিন্ন কাহিনি বর্ণনা কোরে এবং নানাবিধ উপদেশ দিয়ে পাণ্ডবদের কাছে বিদায় নিয়ে কাম্যক বন থেকে চলে গেলেন। তারপর পাণ্ডবগণ দ্বৈতবনে এক সরোবরের নিকট ঘর বানিয়ে বাস করতে লাগলেন। সেই সময়ে হস্তিনাপুরে একদিন শকুনি ও কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, তুমি এখন প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়ে রাজ্যভোগ করছো আর পাণ্ডবরা রাজ্যচ্যুত হয়ে ভিখারীর মতো বনে বাস করছে। এখন একবার তাদের দেখে এসো। পর্বতের উপরে বসবাসকারী লোকে সমতলে বসবাসকারীদেরকে যেমন ভাবে দেখে, সম্পদশালী লোকে তেমন দুর্দশাগ্রস্ত শত্রুকে দেখে, এর চেয়ে সুখজনক আর কিছুই নেই। তোমার পত্নীরাও মূল্যবান বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে হরিণের চর্ম পরিহীতা ভিখারিনীর মতো দ্রৌপদীকে দেখে আসুন।
দুর্যোধন বললেন, তোমরা আমার মনের মতো কথা বলেছ, কিন্তু বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র আমাদের যেতে দেবেন না। শকুনির সঙ্গে পরামর্শ করে কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, দ্বৈতবনের কাছে আমাদের গোপরা থাকে, তারা তোমার প্রতীক্ষা করছে। তোমার গোপপল্লী যাত্রা অবশ্য কর্তব্য, ধৃতরাষ্ট্র তোমাকে অনুমতি দেবেন। এই কথার পর তিনজনে হাতে হাত মেলালেন।
কর্ণ ও শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে বললেন, কুরুরাজ, আপনার গোপপল্লীর গরুদের গণনা আর বাছুরদের চিহ্নিত করবার সময় হয়েছে, এখন মৃগয়ারও উপয়ুক্ত সময়, অতএব আপনি দুর্যোধনকে যাবার অনুমতি দিন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মৃগয়া আর গরু দেখে আসা দুইই ভাল, কিন্তু শুনেছি গোপপল্লীর নিকটেই পাণ্ডবরা বাস করেন, সেজন্য তোমাদের সেখানে যাওয়া উচিত নয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তোমাদের দেখলে ক্রুদ্ধ হবেন না, কিন্তু ভীম অসহিষ্ণু আর ভয়ঙ্কর। তোমরা অহঙ্কার ও মোহের বশে অপরাধ করবে, তার ফলে পাণ্ডবরা তোমাদের বিনষ্ট কোরে ফেলবেন। অর্জুনও ইন্দ্রলোকে অস্ত্রশিক্ষা করে ফিরে এসেছেন। অতএব দুর্যোধন, তুমি নিজে যেয়ো না, পরিদর্শনের জন্য বিশ্বস্ত লোক পাঠাও।
শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির ধর্মজ্ঞ, তিনি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হবেন না, অন্য পাণ্ডবরাও তার অনুগত। আমরা মৃগয়া আর গরু গণনা করার জন্যই যেতে চাচ্ছি, পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য নয়। তারা যেখানে আছেন সেখানে আমরা যাব না। ধৃতরাষ্ট্র অনিচ্ছায় অনুমতি দিলেন। তখন দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসন প্রভৃতি দ্বৈতবনে যাত্রা করলেন, তাদের সঙ্গে ঘোড়া, হাতি, রথ সমেত বিশাল সৈন্য, বহু স্ত্রীলোক, শকট সহ বণিকের দল, বেশ্যা, স্তুতিপাঠক, মৃগয়াজীবী প্রভৃতিও গেল। গোপপল্লীতে উপস্থিত হয়ে দুর্যোধন বহু সহস্র গাভী ও বাছুর পরিদর্শন, গণনা ও চিহিত করলেন এবং গোপালকদের মধ্যে আনন্দে বাস করতে লাগলেন। নাচ, গান ও বাজনায় নিপুণ গোপ ও গোপকন্যারা দুর্যোধনের মনোরঞ্জন করতে লাগলো। তিনি সেই মনোরম স্থানে মৃগয়া, দুগ্ধপান ও বিবিধ ভোগবিলাসে রত হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
দ্বৈতবনের নিকটে এসে দুর্যোধন তার পরিচারকদের আদেশ দিলেন, বিভিন্ন খেলাধূলা করার উপযুক্ত খেলাঘর নির্মাণ কর। সেই সময়ে কুবেরের ভবন থেকে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দ্বৈতবনের সরোবরের নিকট সদলবলে অবস্থান করছিলেন। দুর্যোধনের লোকরা দ্বৈতবনের কাছে এলে, গন্ধর্বরা তাদের বাধা দিল। এই সংবাদ পেয়ে দুর্যোধন তার একদল দুর্ধর্ষ সৈন্যদের বললেন, গন্ধর্বদের তাড়িয়ে দাও। তারা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলে দুর্যোধন বহু যোদ্ধা পাঠালেন। গন্ধর্বগণ মিষ্টি কথায় বারণ করলেও কুরুসৈন্য সবলে দ্বৈতবনে প্রবেশ করলো।
গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর যোদ্ধাদের বললেন, তোমরা ওই অনার্যদের শাসন করো। চিত্রসেনের নির্দেশে সশস্ত্র গন্ধর্বসেনার আক্রমণে কুরুসেনা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণও যুদ্ধে বিমুখ হলেন। কিন্তু মহাবীর কর্ণ নিরস্ত হলেন না, তিনি শত শত গন্ধর্ব বধ কোরে চিত্রসেনের বাহিনী বিধ্বস্ত করলেন। তখন দুর্যোধনাদি কর্ণের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। নিজের সৈন্যদল নিপীড়িত হচ্ছে দেখে চিত্রসেন মায়া অবলম্বন করলেন। গন্ধর্বসৈন্যরা কর্ণের রথ ধ্বংস করে ফেললে কর্ণ লাফ দিয়ে নেমে দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণের রথে উঠে চলে গেলেন। কর্ণের পরাজয় এবং কুরুসেনার পলায়ন দেখেও দুর্যোধন যুদ্ধে বিরত হলেন না। তাঁর রথও নষ্ট হোলো, তিনি মাটিতে পড়ে গিয়ে চিত্রসেনের হাতে বন্দী হলেন। তখন গন্ধর্বরা দুঃশাসন প্রভৃতি এবং তাদের সকলের পত্নীদের ধরে নিয়ে দ্রুতবেগে চলে গেল।
গন্ধর্বগণ দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রভৃতিকে বন্দী কোরে নিয়ে গেলে পরাজিত কুরুসৈন্য বেশ্যা ও বণিকেরা পাণ্ডবগণের শরণাপন্ন হোলো। দুর্যোধনের বৃদ্ধ মন্ত্রীরা মিনতি কোরে যুধিষ্ঠিরের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ভীম বললেন, আমরা যুদ্ধ করে অনেক চেষ্টায় যা করতাম গন্ধর্বরা তা সম্পন্ন করেছে। দুর্যোধন যে উদ্দেশ্যে এসেছিল তা সফল না হয়ে অন্য প্রকার ঘটেছে। আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছি, কিন্তু ভাগ্যক্রমে এমন লোকও আছেন যিনি আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের ভার স্বয়ং নিয়েছেন। ভীমের এই কর্কশ কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, এখন নিষ্ঠুরতার সময় নয়, কৌরবগণ ভীত ও বিপদগ্রস্ত হয়ে আমাদের শরণ নিয়েছে। জ্ঞাতিদের মধ্যে ভেদাভেদ হয়, ঝগড়া হয়, কিন্তু তার জন্য কুলধর্ম নষ্ট হতে পারে না। দুর্যোধন আর কুরুনারীদের হরণের ফলে আমাদের কুল নষ্ট হতে বসেছে, দুর্বুদ্ধি চিত্রসেন আমাদের অবজ্ঞা কোরে এই কাজ করেছেন। বীরগণ, তোমরা বিলম্ব কোরো না, ওঠো, চার ভাই মিলে দুর্যোধনকে উদ্ধার করো। ভীম, বিপন্ন দুর্যোধন জীবনরক্ষার জন্য তোমাদেরই বাহুবল প্রার্থনা করেছে, এর চেয়ে গৌরবের বিষয় আর কি হতে পারে? আমি এখন সাদ্যস্ক যজ্ঞে নিযুক্ত আছি, নয়তো বিনা বিচারে নিজেই তার কাছে দৌড়ে যেতাম। তোমরা মিষ্ট কথায় দুর্যোধনাদির মুক্তি চাইবে, যদি তাতে ফল না হয় তবে বলপ্রয়োগে গন্ধর্বরাজকে পরাস্ত করবে।
যুধিষ্ঠিরের কথায় ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব বর্ম ধারণ করে সশস্ত্র হয়ে দুর্যোধনাদিকে উদ্ধার করার জন্য যাত্রা করলেন, তাঁদের দেখে কৌরবসৈন্যগণ আনন্দধ্বনি করতে লাগল। গন্ধর্বসেনার নিকটে গিয়ে অর্জুন বললেন, আমাদের ভাই দুর্যোধনকে ছেড়ে দাও। গন্ধর্বরা ঈষৎ হেসে বললো, আমরা দেবরাজ ভিন্ন আর কারও আদেশ শুনি না। অর্জুন আবার বললেন, যদি ভাল কথায় না ছাড়ো তবে বলপ্রয়োগ করবো। তার পর গন্ধর্ব ও পাণ্ডবগণের যুদ্ধ আরম্ভ হোলো। অর্জুনের শরবর্ষণে গন্ধর্বসেনা বিনষ্ট হচ্ছে দেখে চিত্রসেন গদাহস্তে যুদ্ধ করতে এলেন, অর্জুন তার গদা শরাঘাতে কেটে ফেললেন। চিত্রসেন মায়াবলে অন্তর্হিত হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে শব্দবেধী বাণ দিয়ে তাঁকে বধ করতে উদ্যত হলেন। তখন চিত্রসেন দর্শন দিয়ে বললেন, আমি তোমার বন্ধু।
চিত্রসেনকে দুর্বল দেখে অর্জুন তাঁর বাণ সংহত করে হাসিমুখে বললেন, বীর, তুমি দুর্যোধনাদি আর তার পত্নীদের হরণ করেছ কেন? চিত্রসেন বললেন, অর্জুন, দুরাত্মা দুর্যোধন আর কর্ণ তোমাদের উপহাস করবার জন্য এখানে এসেছে জানতে পেরে দেবরাজ ইন্দ্র আমাকে বললেন, যাও, দুর্যোধন আর তার মন্ত্রণাদাতাদের বেঁধে নিয়ে এসো। তার আদেশ অনুসারে আমি এদের সুরলোকে নিয়ে যাবো। তার পর চিত্রসেন যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন এবং তার অনুরোধে দুর্যোধন প্রভৃতিকে মুক্তি দিলেন। যুধিষ্ঠির গন্ধর্বদের প্রশংসা কোরে বললেন, তোমরা বলবান, তথাপি ভাগ্যক্রমে এঁদের বধ করনি। বৎস চিত্রসেন, তোমরা আমার মহা উপকার করেছো, আমার কুলের মর্যাদাহানি করনি।
চিত্রসেন বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। তারপর দেবরাজ ইন্দ্র অমৃত বর্ষণ করে নিহত গন্ধর্বগণকে পুনর্জীবিত করলেন। কৌরবগণ তাদের স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে পাণ্ডবদের গুণকীর্তন করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে বললেন, আর কখনও এমন দুঃসাহসের কাজ কোরো না। এখন তোমরা নিরাপদে স্বচ্ছন্দে হস্তিনাপুরে ফিরে যাও, মনে কোনও দুঃখ রেখো না। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে দুর্যোধন লজ্জায় ও দুঃখে অধোমুখ হয়ে বিকলাঙ্গের মতো হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।
______________
(ক্রমশ)