মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬৭
দুর্যোধনের অনশনের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
দুর্যোধনের অনশনের কাহিনি
দুর্যোধনাদি চিত্রসেনের হাতে বন্দী হওয়ার পরে এবং পাণ্ডবদের সহায়তায় মুক্তি পেয়ে লজ্জায় ও দুঃখে অপমানিত হয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। হস্তিনাপুরে ফিরে যাওয়ার সময় শোকে, অপমানে অভিভূত হয়ে নিজের পরাজয়ের কথা ভাবতে ভাবতে দুর্যোধন তাঁর চতুরঙ্গ সেনার পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। পথে এক স্থানে যখন তিনি বিশ্রাম করছিলেন তখন কর্ণ তার কাছে এসে বললেন, ভাগ্যক্রমে তুমি গন্ধর্বদের জয় করেছ এবং তোমার সঙ্গে আমার আবার মিলন হোলো। আমি যখন শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলাম তখন গন্ধর্বরা আমায় তাড়া করেছিল, সেইজন্য আমি যুদ্ধস্থল থেকে চলে গিয়েছিলাম। এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে তুমি ও তোমার ভাইয়েরা জয়ী হয়ে অক্ষতদেহে ফিরে এসেছ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি।
অধোমুখে ক্ষীণস্বরে দুর্যোধন বললেন, কর্ণ, তুমি প্রকৃত ঘটনা জান না। বহুক্ষণ যুদ্ধের পর গন্ধর্বরা আমাদের পরাস্ত করে এবং স্ত্রী পুত্র অমাত্য প্রভৃতি সহ আমাকে ও আমার ভাইদেরকে বন্দী কোরে নিয়ে যায়। পাণ্ডবগণ সংবাদ পেয়ে আমাদের উদ্ধার করতে আসেন। তারপর চিত্রসেন আর অর্জুন আমাকে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে যান, যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে আমরা মুক্তি পেয়েছি। চিত্রসেন যখন বললেন যে আমরা পাণ্ডবদের দুর্দশা দেখতে এসেছিলাম, তখন লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হোলো। এর চেয়ে যুদ্ধে মরাই আমার পক্ষে ভাল হতো। আমি হস্তিনাপুরে যাব না, এইখানেই অনশনে প্রাণত্যাগ করবো, তোমরা ফিরে যাও। দুঃশাসন, তুমি কর্ণ আর শকুনির সহায়তায় রাজ্যশাসন করো।
দুঃশাসন কাতর হয়ে দুর্যোধনের পায়ে পড়ে বললেন, এ কখনই হতে পারে না। কর্ণ বললেন, তোমার মানসিক দুর্বলতা আজ দেখলাম। সেনানায়ক অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধে শত্রুর হাতে যেমন বন্দী হন তেমন আবার নিজের সৈন্য দ্বারা মুক্তও হন। তোমারই রাজ্যবাসী পাণ্ডবরা তোমাকে মুক্ত করেছে, তাতে দুঃখ কিসের? পাণ্ডবরা তোমার দাস, সেকারণেই তোমার সহায় হয়েছে।
শকুনি বললেন, আমি তোমাকে পাশা খেলার দ্বারা বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী করেছি, কিন্তু তুমি নির্বুদ্ধিতার জন্য সে সমস্ত ত্যাগ করে মরতে চাচ্ছ। পাণ্ডবরা তোমার উপকার করেছে তাতে তোমার আনন্দিত হওয়াই উচিত। তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সুসম্পর্ক কোরে তাদের পৈতৃক রাজ্য ফিরিয়ে দাও, তাতে তোমার যশ, ধর্ম ও সুখ লাভ হবে।
দুর্যোধন কিছুতেই প্রবোধ মানলেন না, অনশনের সংকল্পও ছাড়লেন না। তখন তার শুভানুধ্যায়ীরা বললেন, তোমার যে পরিণতি আমাদেরও তাই, আমরা তোমাকে ছেড়ে যাব না। তার পর দুর্যোধন আচমন করে পবিত্র হলেন এবং কুশবস্ত্র ধারণ কোরে মৌনী হয়ে স্বর্গলাভের কামনায় কুশশয্যায় শয়ন করে ঘুমিয়ে নানা স্বপ্ন দেখলেন।
দেবতাদের কাছে পরাজিত হয়ে দানবগণ পাতালে বাস করছিল। দুর্যোধনের অনশনের ফলে তাদের ক্ষতি হবে জেনে তারা এক যজ্ঞ করলো। যজ্ঞ সমাপ্ত হলে এক অদ্ভুত ভয়ঙ্কর কৃত্যা প্রকট হয়ে বললো, আমাকে কি করতে হবে? দানবরা বললে, দুর্যোধন অনশন করেছেন, তাকে এখানে নিয়ে এসো। মুহূর্তের মধ্যে সেই কৃত্যা দুর্যোধনকে পাতালে নিয়ে এল। দানবরা তাকে বললো, রাজা দুর্যোধন, আত্মহত্যায় নরকবাস ও যশের হানি হয়, সুতরাং অনশনের সংকল্প ত্যাগ করো। আমরা মহাদেবের তপস্যা কোরে তোমাকে পেয়েছি, তিনি তোমার শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ বজ্রের ন্যায় কঠিন ও অস্ত্রের অভেদ্য করেছেন, আর পার্বতী তোমার নিম্নাঙ্গ ফুলের মতো কোমল ও নারীদের কাছে আকর্ষণীয় করেছেন। মহাদেব ও পার্বতী তোমার দেহ নির্মাণ করেছেন সেজন্য তুমি দিব্যপুরুষ, সাধারণ মানুষ নও। তোমাকে সাহায্য করবার জন্য দানব ও অসুরগণ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তারা ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতির দেহে প্রবেশ করবেন, তার ফলে তারা দয়া ত্যাগ কোরে তোমার শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, পুত্র, ভাই, বন্ধু, শিষ্য কাউকে নিষ্কৃতি দেবেন না। নিহত নরকাসুরের আত্মা কর্ণের দেহে প্রবেশ কোরে কৃষ্ণ ও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। আমরা সংশপ্তক নামে বহু সহস্র দৈত্য ও রাক্ষস নিযুক্ত করেছি, তারা অর্জুনকে বধ করবে। তুমি শত্রুহীন হয়ে পৃথিবী ভোগ করবে। অতএব শোক ত্যাগ করে রাজ্যে ফিরে যাও। আমরা তোমার আর পাণ্ডবগণ দেবতাদের পক্ষ অবলম্বন করবে।
দানবগণ দুর্যোধনকে আশ্বাস দিয়ে আলিঙ্গন করলো। তারপর কৃত্যা তাঁকে পূর্বস্থানে রেখে এলো। এইরূপ স্বপ্নদর্শনের পর দুর্যোধনের দৃঢ় বিশ্বাস হোলো যে পাণ্ডবগণ যুদ্ধে পরাজিত হবেন। তিনি স্বপ্নের বৃত্তান্ত প্রকাশ করলেন না। রাত্রি শেষ হোলে কর্ণ হাসিমুখে তাকে বললেন, ওঠো, মরলে শত্রুকে জয় করা যায় না, জীবিত থাকলেই তা সম্ভব হয়। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যুদ্ধে অর্জুনকে বধ করবো। তার পর দুর্যোধন সদলে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন।
______________
(ক্রমশ)