Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 94

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৪

নারদ বর্ণিত বিশ্বামিত্র, গালব, যযাতি ও মাধবীর কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

নারদ বর্ণিত বিশ্বামিত্র, গালব, যযাতি ও মাধবীর কাহিনি

মহর্ষি কণ্বের প্রতি দুর্যোধনের উপহাস বাক্য শোনার পর নারদ বললেন, দুর্যোধন, শুভানুধ্যায়ীগণের কথা তোমার শোনা উচিত, কোনও বিষয়ে জিদ ভালো নয়, তার ফল ভয়ংকর হয়। একটি প্রাচীন ঘটনা বলছি শোন - পুরাকালে বিশ্বামিত্র যখন তপস্যা করছিলেন, তখন তার কাছে বশিষ্ঠের রূপ ধরে স্বয়ং ধর্মদেব উপস্থিত হলেন। ক্ষুধার্ত অতিথিকে দেখে বিশ্বামিত্র ব্যস্ত হয়ে পরমান্নের চরু রান্না করতে লাগলেন। ধর্ম অপেক্ষা করলেন না, অন্য তপস্বীদের দেওয়া অন্ন ভোজন করলেন। তারপর বিশ্বামিত্র অন্ন নিয়ে এলে ধর্ম বললেন, আমি ভোজন করেছি, যে পর্যন্ত ফিরে না আসি তত কাল তুমি অপেক্ষা করো। বিশ্বামিত্র দুই হাতে মাথার উপর অন্নপাত্র ধরে বায়ুভোজী ও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এই সময়ে শিষ্য গালব তার পরিচর্যা করতে লাগলেন। এক বছর পরে বশিষ্ঠরূপী ধর্ম ফিরে এসে বললেন, বিশ্বামিত্র, আমি তুষ্ট হয়েছি। এই বলে তিনি অন্ন ভোজন করে চলে গেলেন।

বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়ত্ব ত্যাগ করে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করলেন এবং প্রীত হয়ে গালবকে বললেন, বৎস, তুমি এখন যেখানে ইচ্ছা হয় যেতে পারো। গালব বললেন, আপনাকে গুরুদক্ষিণা কি দেবো? তিনি বার বার এই প্রশ্ন করায় বিশ্বামিত্র কিঞ্চিৎ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আমাকে আট শত এমন ঘোড়া দাও যাদের দেখতে চাঁদের মতো শুভ্র এবং একটি কান শ্যামবর্ণ।

গালব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বিষ্ণুকে স্মরণ করতে লাগলেন। তখন তাঁর সখা গরুড় এসে বললেন, গালব, আমার সঙ্গে এসো, তোমার কামনা পূর্ণ হবে। গরুড় গালবকে নিয়ে নানা দিকে নানা লোকে ভ্রমণ করলেন এবং পরিশেষে রাজা যযাতির কাছে এসে গালবের গুরুদক্ষিণার জন্য ঘোড়া প্রার্থনা করলেন। যযাতি গরুড়কে বললেন, সখা, আমি পূর্বের ন্যায় ধনবান নই, কিন্তু এই ব্রহ্মর্ষিকে নিরাশও করতে পারি না। গালব, আপনি আমার কন্যা মাধবীকে নিয়ে যান, বিভিন্ন রাজাদের কাছে গেলে তারা এই কন্যার সঙ্গে মিলিত হওয়ার মূল্যস্বরূপ নিশ্চয় আপনাকে আট শত ঘোড়া দেবেন, আমিও দৌহিত্র লাভ করবো।

যযাতির কন্যা মাধবীকে নিয়ে গালব অযোধ্যার রাজা হর্ষশ্বের কাছে গেলেন। তাঁর প্রার্থনা শুনে হর্ষশ্ব বলেলন, এই কন্যা অতি শুভলক্ষণা, ইনি রাজচক্রবর্তী পুত্রের জন্ম দিতে পারবেন। কিন্তু আপনি মূল্যস্বরূপ যা চান তেমন ঘোড়া আমার কাছে দুই শত মাত্র আছে। আমি এই কন্যার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করবো, আপনি আমার কামনা পূর্ণ করুন। মাধবী গালবকে বললেন, এক ব্রহ্মবাদী মুনি আমাকে বর দিয়েছেন, তুমি প্রত্যেক বার সন্তান প্রসবের পর আবার কুমারী হবে। অতএব আপনি দুই শত ঘোড়া নিয়ে আমাকে দান করুন। এর পরে আরও তিন রাজার কাছে আমাকে নিয়ে যাবেন, তাতে আপনি আট শত ঘোড়া পেয়ে যাবেন, আমারও চার পুত্র লাভ হবে। গালব হর্ষশ্বকে বললেন, মহারাজ, মূল্যের চতুর্থাংশ দিয়ে আপনি এই কন্যার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করুন।

যথাকালে হর্ষশ্ব মাধবীর গর্ভজাত বসুমনা নামে একটি পুত্র লাভ করলেন। তখন গালব তার কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনি পুত্র পেয়েছেন, এখন অবশিষ্ট ঘোড়ার জন্য আমাকে অন্য রাজাদের কাছে যেতে হবে। সত্যবাদী হর্ষশ্ব তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুসারে মাধবীকে প্রত্যর্পণ করলেন, মাধবীও পুনর্বার কুমারী হয়ে গালবের সঙ্গে চললেন। তার পর গালব একে একে কাশীরাজ দিবোদাস এবং ভোজরাজ উশীনরের কাছে গেলেন। তাঁরাও প্রত্যেকে দুই শত ঘোড়া দিয়ে মাধবীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করলে তাঁদের পুত্রের নাম হোলো যথাক্রমে প্রতর্দন ও শিবি।

গরুড় গালবকে বললেন, পূর্বে মহর্ষি ঋচীক কান্যকুব্জরাজ গাধিকে এই রকম এক হাজার ঘোড়া উপঢৌকন দিয়ে তার কন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করেছিলেন। এই সকল ঘোড়া ঋচিক বরুণের ভবনে পেয়েছিলেন। মহারাজ গাধি ব্রাহ্মণগণকে সমস্ত ঘোড়া দান করেন, তাঁদের কাছ থেকে হর্ষশ্ব, দিবোদাস ও উশীনর প্রত্যেকে দুই শত ঘোড়া কিনেছিলেন, অবশিষ্ট চার শত ঘোড়া চুরি হয়ে যায়। এই কারণে আর এমন ঘোড়া পাওয়া যাবে না, তুমি এই ছয় শত ঘোড়া বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা হিসাবে দাও।

বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে গালব বললেন, আপনি গুরুদক্ষিণাস্বরূপ এই ছয় শত ঘোড়া নিন এবং অবশিষ্ট দুই শতের পরিবর্তে এই কন্যাকে নিন। তিন জন রাজর্ষি এঁর গর্ভে তিনটি ধার্মিক পুত্র উৎপাদন করেছেন, আপনি চতুর্থ পুত্র উৎপাদন করুন। বিশ্বামিত্র বললেন, গালব, তুমি প্রথমেই এই কন্যা আমাকে দাও নি কেন, তা হলে আমার চারটি বংশধর পুত্র হতো। বিশ্বামিত্র মাধবীকে নিলেন, ঘোড়াগুলি তার আশ্রমে বিচরণ করতে লাগল। যথাকালে অষ্টক নামে মাধবীর একটি পুত্র হোলো। বিশ্বামিত্র এই পুত্রকে ধর্ম, অর্থ, ও ঘোড়াগুলি দান করলেন এবং মাধবীকে শিষ্য গালবের হাতে দিয়ে বনে চলে গেলেন।

গালব মাধবীকে বললেন, তোমার প্রথম পুত্র বসুমনা দাতা, দ্বিতীয় প্রতর্দন বীর, তৃতীয় শিবি সত্যধর্ম পালনকারী এবং চতুর্থ অষ্টক যজ্ঞকারী। তুমি এই চার পুত্র প্রসব কোরে আমাকে, চার জন রাজাকে এবং তোমার পিতাকে উদ্ধার করেছ। তারপর গরুড়ের সম্মতি নিয়ে গালব মাধবীকে যযাতির কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বনে তপস্যা করতে গেলেন।

যযাতি তার কন্যার স্বয়ংবর করাবার ইচ্ছা করলেন। যযাতির পুত্র যদু ও পুরু তাদের বোনকে রথে নিয়ে গঙ্গা আর যমুনার সংগমের কাছে আশ্রমে গেলেন। বহু রাজা এবং নাগ, যক্ষ, গন্ধর্ব প্রভৃতি স্বয়ংবরে উপস্থিত হলেন, কিন্তু মাধবী সকলকে প্রত্যাখ্যান করে তপোবনকেই বরণ করলেন। তিনি হরিণীর মতো বনচারিণী হয়ে বিবিধ ব্রতনিয়ম ও ব্রহ্মচর্য পালন করে ধর্মসঞ্চয় করতে লাগলেন।

দীর্ঘ আয়ু ভোগ করে যযাতি স্বর্গে গেলেন। বহু বর্ষ স্বর্গবাসের পর তিনি মোহবশে দেবতা, ঋষি ও মনুষ্যকে অবজ্ঞা করতে লাগলেন। স্বর্গবাসী রাজর্ষিগণ তাকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, এ কেন স্বর্গে এলো ? কে একে চেনে? সকলেই বললেন, আমরা একে চিনি না। তখন যযাতির তেজ নষ্ট হোলো, তিনি তার আসন থেকে পড়ে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর দিকে পড়তে লাগলেন। দেবরাজের এক দূত এসে তাকে বললেন, রাজা, তুমি অত্যন্ত অহংকারী, সকলকেই অপমান করো, তুমি স্বর্গবাসের যোগ্য নও, অহংকারের জন্যই তোমার পতন হোলো। যযাতি স্থির করলেন, আমি সাধুজনের মধ্যেই পতিত হবো। সেই সময়ে প্রতর্দন, বসুমনা, শিবি ও অষ্টক নৈমিষারণ্যে বাজপেয় যজ্ঞ করছিলেন। যজ্ঞের ধোঁয়া অবলম্বন করে যযাতি সেই চার রাজার মধ্যে নেমে এলেন। তখন মাধবীও ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এলেন এবং পিতা যযাতিকে প্রণাম করে বললেন, এই চার জন আমার পুত্র, আপনার দৌহিত্র। আমি যে ধর্ম সঞ্চয় করেছি তার অর্ধেক আপনি নিন। প্রতর্দন প্রভৃতি রাজারা তাদের জননী ও মাতামহকে প্রণাম করলেন। গালবও হঠাৎ সেখানে এসে বললেন, রাজা, আমার তপস্যার অষ্টম ভাগ নিয়ে আপনি স্বর্গারোহণ করুন।

সাধুজন তাকে চিনতে পারলে তখনই যযাতির পতন নিবারিত হোলো। প্রতর্দন প্রভৃতি উচ্চকণ্ঠে বললেন, আমরা সৎকর্মের ফলে যে পুণ্য লাভ করেছি তা আপনাকে দিলাম, তার প্রভাবে আপনি স্বর্গারোহণ করুন। যযাতি ভূমি স্পর্শ করলেন না, দৌহিত্রগণের উক্তির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গে উঠতে লাগলেন। দেবতারা তাকে সাদরে অভিনন্দন জানালেন। ব্রহ্মা বললেন, মহারাজ, তুমি বহু যজ্ঞ, দান ও প্রজাপালন কোরে যে পুণ্য অর্জুন করেছিলে তা তোমার অহংকারের ফলে নষ্ট হয়েছিল, তাই তুমি স্বর্গবাসীদের ধিক্কারে পতিত হয়েছিলে। অহংকার, হিংসা, কপটতা বা শঠতা থাকলে স্বর্গবাস চিরস্থায়ী হয় না। উত্তম, মধ্যম বা অধম কাউকে তুমি অপমান কোরো না, অহংকারী লোকেরাই শাস্তি পায়।

কাহিনি শেষ করে নারদ বললেন, অহংকারের ফলে যযাতি স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন, অতিশয় জেদের জন্য গালবও দুঃখভোগ করেছিলেন। দুর্যোধন, তুমি অহংকার, ক্রোধ ও যুদ্ধের অভিপ্রায় ত্যাগ করো, পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করো।

______________

(ক্রমশ)