Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 136

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৩৬

চতুর্দশ দিনের রাত্রে কৌরবসেনার বিরুদ্ধে অর্জুন ও ঘটোৎকচের ভয়ানক যুদ্ধ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

চতুর্দশ দিনের রাত্রে কৌরবসেনার বিরুদ্ধে অর্জুন ও ঘটোৎকচের ভয়ানক যুদ্ধ

রাতের অন্ধকারে বিভ্রান্ত হয়ে সৈন্যরা পরস্পরকে বধ করছে দেখে দুর্যোধন তার পদাতিক সেনাদের বললেন, তোমরা অস্ত্র ত্যাগ করে হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ নাও। পদাতিকরা প্রদীপ ধরলে যুদ্ধভূমির অন্ধকার দূর হোলো। পাণ্ডবরাও পদাতিক সৈন্যের হাতে প্রদীপ দিলেন। প্রত্যেক হাতির পিঠে সাত, রথের উপর দশ, ঘোড়ার পিঠে দুই এবং সেনার পাশে, পিছনে ও পতাকার দণ্ডেও প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হোলো।

সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিযুদ্ধে এক বার পাণ্ডবপক্ষের অন্য বার কৌরবপক্ষের জয় হতে লাগল। স্বয়ংবরসভায় যেমন আগত ব্যক্তিদের নাম ঘোষিত হয় তেমন রাজারা নিজেদের নাম ও পরিচয় শুনিয়ে বিপক্ষ সৈনিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অর্জুনের প্রবল শরবর্ষণে কৌরবসৈন্য ভয় পেয়ে পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন দ্রোণ ও কর্ণকে বললেন, অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করেছে সেজন্য ক্রুদ্ধ হয়ে আপনারাই রাত্রিকালে এই যুদ্ধ আরম্ভ করেছেন। পাণ্ডবসৈন্য আমাদের সৈন্য সংহার করছে আর আপনারা অক্ষমের মতো তা দেখছেন। আমি জানতে চাই, যদি আমাকে ত্যাগ করাই আপনাদের ইচ্ছা ছিলো তবে আমাকে আশ্বাস দেওয়া আপনাদের উচিত হয়নি। আপনাদের অভিপ্রায় জানলে এই সৈন্যক্ষয়কর যুদ্ধ আরম্ভ করতাম না। যদি আমাকে ত্যাগ করতে না চান তবে যুদ্ধে আপনাদের বিক্রম প্রকাশ করুন। দুর্যোধনের বাক্যে দ্রোণ ও কর্ণ আহত বাঘের মতো উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন।

কর্ণের শরবর্ষণে আকুল হয়ে পাণ্ডবসৈন্য পালাচ্ছে দেখে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, আমাদের যোদ্ধারা আতঙ্কিত হয়ে পালাচ্ছে, কর্ণের শরবর্ষণে কোনও অবকাশ দেখা যাচ্ছে না, কর্ণ নিশ্চয় আজ আমাদের সংহার করবেন। অর্জুন, কর্ণের বধের জন্য যা করা উচিত তা করো। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, আমাদের রথীরা পালাচ্ছেন আর কর্ণ নির্ভয়ে তাদের শরাঘাত করছেন, এ আমি সইতে পারছি না। কৃষ্ণ, শীঘ্র কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চলো, হয় আমি তাঁকে মারব না হয় তিনি আমাকে মারবেন।

কৃষ্ণ বললেন, তুমি অথবা রাক্ষস ঘটোৎকচ ভিন্ন আর কেউ কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না। এখন তার সঙ্গে তোমার যুদ্ধ করা আমি উচিত মনে করি না, কারণ তাঁর কাছে ইন্দ্রদত্ত শক্তি অস্ত্র আছে, তোমাকে মারবার জন্য কর্ণ এই ভয়ংকর অস্ত্র সর্বদা সঙ্গে রাখেন। অতএব ঘটোৎকচই তার সঙ্গে যুদ্ধ করুক। ভীমের এই পুত্রের কাছে দেবতা, রাক্ষস ও অসুর সর্বপ্রকার অস্ত্রই রয়েছে, সে কর্ণকে জয় করবে তাতে আমার সংশয় নেই।

কৃষ্ণের ডাক শুনে সশস্ত্র ঘটোৎকচ এসে অভিবাদন করলেন। কৃষ্ণ ঘটোৎকচকে বললেন, পুত্র ঘটোৎকচ, এখন একমাত্র তোমারই বিক্রম প্রকাশের সময় উপস্থিত হয়েছে। তোমার আত্মীয়গণ বিপদাপন্ন হয়েছেন, তুমি তাদের রক্ষা করো। কর্ণ পাণ্ডবসৈন্য বিধ্বস্ত করছেন, ক্ষত্রিয় বীরগণকে হত্যা করছেন, এই রাতে পাঞ্চালরা সিংহের ভয়ে হরিণের মতো পালিয়ে যাচ্ছে। তোমার নানাবিধ অস্ত্র ও রাক্ষসী মায়া আছে আর রাক্ষসগণ রাতেই অধিক বলবান হয়।

অর্জুন বললেন, ঘটোৎকচ, আমি মনে করি সমস্ত সৈন্যদের মধ্যে তুমি, সাত্যকি আর ভীম এই তিন জনই শ্রেষ্ঠ। তুমি এই রাতে কর্ণের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ করো, সাত্যকি তোমার রক্ষক হবেন।

ঘটোৎকচ বললেন, আমি একাই কর্ণ, দ্রোণ এবং অন্য ক্ষত্রিয় বীরগণকে জয় করতে পারি। আমি এমন যুদ্ধ করবো যে লোকে চিরকাল তার কথা বলবে। কোনও বীরকে আমি ছাড়ব না, ভয়ে হাত জোড় করলেও নয়, রাক্ষসধর্ম অনুসারে সকলকেই বধ করবো। এই বলে ঘটোৎকচ কর্ণের দিকে ধেয়ে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)