মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৩৭
চতুর্দশ দিনের রাত্রে কর্ণের হাতে ঘটোৎকচ বধ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
চতুর্দশ দিনের রাত্রে কর্ণের হাতে ঘটোৎকচ বধ
ঘটোৎকচের দেহ বিশাল, চোখ লাল, দাড়ি হলুদ বর্ণের, মুখ আকৰ্ণবিস্তৃত, দেহ নীলবর্ণ, মাথা বিশাল। তাঁর দেহে কাঁসার তৈরী উজ্জ্বল বর্ম, মাথায় শুভ্র মুকুট, কানে উজ্জ্বল কুণ্ডল। তার বিশাল রথ ভল্লুকের চামড়ায় ঢাকা এবং একশত ঘোড়া দ্বারা বাহিত। সেই রথের আকাশস্পর্শী পতাকা উপর এক ভীষণ মাংসাশী শকুন বসে আছে।
কর্ণ ও ঘটোৎকচ শরক্ষেপণ করতে করতে পরস্পরের দিকে ধাবিত হলেন। কিছুক্ষণ পরে ঘটোৎকচ মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করলেন। ঘোরদর্শন রাক্ষস সৈন্য আবির্ভূত হয়ে পাথর, লোহার চাকা, তোমর, শূল, শতঘ্নী, পট্টিশ প্রভৃতি বর্ষণ করতে লাগল, কৌরব যোদ্ধারা ভীত হয়ে পিছিয়ে গেলেন, কেবল কর্ণ অবিচলিত থেকে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। শরবিদ্ধ হয়ে ঘটোৎকচের দেহ শজারুর ন্যায় কণ্টকিত হোলো। একবার দেখা দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে কখনও আকাশে উঠে কখনও ভূমি বিদীর্ণ করে উঠে ঘটোৎকচ যুদ্ধ করতে লাগলেন। সহসা তিনি নিজেকে বহু রূপে বিভক্ত করলেন, সিংহ, বাঘ, সাপ, বিশাল পাখি, রাক্ষস, পিশাচ, কুকুর প্রভৃতি হয়ে কর্ণকে ভক্ষণ করতে গেল। শরাঘাতে কর্ণ তাদের একে একে বধ করলেন।
অলায়ুধ নামে এক রাক্ষস দুর্যোধনের কাছে এসে বললো, মহারাজ, হিড়িম্ব, বক ও কির্মীর আমার বন্ধু ছিলেন, ভীম তাদের বধ করেছে, কন্যা হিড়িম্বাকে ধর্ষণ করেছে। আমি আজ কৃষ্ণ ও পাণ্ডবগণকে সসৈন্যে হত্যা করে ভক্ষণ করবো। দুর্যোধনের অনুমতি পেয়ে অলায়ুধ ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেল। ঘটোৎকচ তার মুণ্ড কেটে দুর্যোধনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। তার মায়াসৃষ্ট রাক্ষসগণ অগণিত সৈন্য বধ করতে লাগল। কুরুবীরগণ রণে ভঙ্গ দিয়ে বললেন, কৌরবগণ, পালাও, ইন্দ্রাদি দেবতারা পাণ্ডবদের জন্য আমাদের বধ করছেন।
চক্ৰযুক্ত একটি শতঘ্নী নিক্ষেপ করে ঘটোৎকচ কর্ণের রথের চার ঘোড়া বধ করলেন। কৌরবগণ সকলে কর্ণকে বললেন, তুমি শীঘ্র শক্তি অস্ত্রে এই রাক্ষসকে বধ করো, নতুবা আমরা সসৈন্যে বিনষ্ট হবো। কর্ণ দেখলেন, ঘটোৎকচ সৈন্যসংহার করছেন, কৌরবগণ ভীত হয়ে আর্তনাদ করছেন। তখন তিনি ইন্দ্রপ্রদত্ত বৈজয়ন্তী শক্তি নিলেন। অর্জুনকে বধ করবার জন্য কর্ণ বহু বৎসর এই অস্ত্র সযত্নে রেখেছিলেন। এখন তিনি সেই ভীষণ শক্তি অস্ত্র ঘটোৎকচের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। ঘটোৎকচ ভীত হয়ে নিজের দেহ পর্বতের ন্যায় বিশাল আকৃতি কোরে দ্রুতবেগে পিছনে সরে গেলেন। কর্ণের নিক্ষিপ্ত শক্তি ঘটোৎকচের সমস্ত মায়া নষ্ট কোরে এবং তার বক্ষ বিদীর্ণ কোরে আকাশে নক্ষত্রগণের মধ্যে চলে গেল। মরণকালে ঘটোৎকচ আর এক আশ্চর্য কাজ করলেন। তিনি পর্বত ও মেঘের মতো বিশাল দেহ ধারণ করে আকাশ থেকে পতিত হলেন আর তার প্রাণহীন দেহের চাপে অসংখ্য কৌরবসেনা নিষ্পেষিত হয়ে মারা গেল। ঘটোৎকচের মৃত্যুতে কৌরবগণ আনন্দিত হয়ে গর্জন করতে লাগলেন আর কর্ণ ইন্দ্রের ন্যায় পূজিত হলেন।
ঘটোৎকচের মৃত্যুতে পাণ্ডবগণ শোকে অশ্রুমোচন করতে লাগলেন, কিন্তু কৃষ্ণ খুশি হয়ে গর্জন কোরে অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। তিনি ঘোড়ার রশি সংযত করে রথের উপর নাচ করতে লাগলেন। অর্জুন অখুশি হয়ে বললেন, কৃষ্ণ, আমরা শোকগ্রস্ত হয়েছি আর এই সময়ে তুম আনন্দ প্রকাশ করছো? তোমার এই আচরণের কারণ কি?
কৃষ্ণ বললেন, আজ কর্ণ ঘটোৎকচের উপর শক্তি নিক্ষেপ করেছেন, তার ফলে তিনি নিজেই যুদ্ধে নিহত হবেন। ভাগ্যক্রমে কর্ণের অক্ষয় কবচ আর কুন্ডল দূর হয়েছে, ভাগ্যক্রমে ইন্দ্রদত্ত অমোঘ শক্তিও ঘটোৎকচকে মেরে ইন্দ্রের কাছে ফিরে গিয়েছে। অর্জুন, তোমার হিতের জন্যই আমি জরাসন্ধ, শিশুপাল ইত্যাদিকে একে একে নিহত করিয়েছি, হিড়িম্ব, কির্মীর, বক, অলায়ুধ এবং উগ্রকর্মা ঘটোৎকচকেও নিপাতিত করিয়েছি। অর্জুন বললেন, আমার হিতের জন্য কেন? কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, জরাসন্ধ, শিশুপাল ইত্যাদিরা না মরলে এখন ভয়ের কারণ হতেন, দুর্যোধন নিশ্চয় তাদের বরণ করতেন এবং তারাও এই যুদ্ধে কুরুপক্ষে যেতেন। তোমার সহায়তায় দেবদ্বেষীদের বিনাশ এবং জগতের হিতসাধনের জন্য আমি জন্মেছি। হিড়িম্ব, বক আর কির্মীরকে ভীম মেরেছেন, ঘটোৎকচ অলায়ুধকে মেরেছে, কর্ণ ঘটোৎকচের উপর শক্তি নিক্ষেপ করেছেন। কর্ণ যদি বধ না করতেন তবে আমিই ঘটোৎকচকে বধ করতাম, কিন্তু তোমাদের খুশির জন্য তা করিনি। এই রাক্ষস ব্রাহ্মণদ্বেষী, যজ্ঞদ্বেষী, ধর্মনাশক পাপাত্মা, সেজন্যই কৌশলে তাকে বধ করিয়েছি, ইন্দ্রের শক্তিও ব্যবহার করিয়েছি। আমিই কর্ণকে বিমোহিত করেছিলাম, তাই তিনি তোমার জন্য রাখা শক্তি অস্ত্র ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করেছেন।
ঘটোৎকচের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠির কাতর হয়েছেন দেখে কৃষ্ণ বললেন, আপনি শোক করবেন না। আপনি উঠুন, যুদ্ধ করুন, দায়িত্ব পালন করুন। আপনি শোকাকুল হলে আমাদের জয়লাভ হবে না। যুধিষ্ঠির হাত দিয়ে চোখ মুছে কৃষ্ণকে বললেন, যে লোক উপকার মনে রাখে না তার ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়। আমাদের বনবাসকালে ঘটোৎকচ বালক হলেও বহু সাহায্য করেছিল। অর্জুনের অনুপস্থিতিকালে সে কাম্যক বনে আমাদের কাছে ছিলো, যখন আমরা গন্ধমাদন পর্বতে যাই তখন তার সাহায্যেই আমরা অনেক দুর্গম স্থান পার হতে পেরেছিলাম, পরিশ্রান্তা পাঞ্চালীকেও সে বহন করেছিল। এই যুদ্ধে সে আমার জন্য বহু দুঃসাধ্য কাজ করেছে। সে আমার ভক্ত ও প্রিয় ছিল, তার জন্য আমি শোকার্ত হয়েছি। কৃষ্ণ, তুমি ও আমরা জীবিত থাকতে এবং অর্জুনের সামনে ঘটোৎকচ কেন কর্ণের হাতে নিহত হোলো? অর্জুন অল্প কারণে জয়দ্রথকে বধ করেছে, তাতে আমি বিশেষ খুশি হইনি। যদি শত্রুবধ করাই ন্যায্য হয়, তবে আগে দ্রোণ ও কর্ণকেই বধ করা উচিত, এঁরাই আমাদের দুঃখের মূল। যেখানে দ্রোণ আর কর্ণকে মারা উচিত সেখানে অর্জুন জয়দ্রথকে মেরেছেন। ভীম এখন দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, আমি নিজেই কর্ণকে বধ করতে যাবো।
যুধিষ্ঠির বেগে কর্ণের দিকে যাচ্ছিলেন এমন সময় ব্যাসদেব এসে তাকে বললেন, ভাগ্যক্রমে অর্জুন কর্ণের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ করেনি, তাই সে ইন্দ্রদত্ত শক্তির আঘাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। ঘটোৎকচ নিহত হওয়ায় অর্জুন রক্ষা পেয়েছে। বৎস, ঘটোৎকচের জন্য শোক কোরো না, তুমি ভাইদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করো। আর পাঁচদিন পরে তুমি পৃথিবীর অধিপতি হবে। তুমি সর্বদা ধর্মের চিন্তা করো, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হয়। এই বলে ব্যাস অন্তর্হিত হলেন।
______________
(ক্রমশ)