Read Creation Theory: The Music of Vedas and Science by Yogi Krishnadev Nath in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

সৃষ্টি তত্ত্ব: বেদ ও বিজ্ঞানের সঙ্গীত



সৃষ্টি তত্ত্ব : বেদ ও আধুনিক বিজ্ঞানের মিলন

মানুষ চিরকাল জানতে চেয়েছে— এই বিশাল বিরাট অনন্ত মহাবিশ্ব কোথা থেকে এসেছে ? কেমন করে হলো আকাশ-নক্ষত্র, পৃথিবী আর প্রাণের বিস্তার ? বেদ থেকে বাইবেল, কুরআন থেকে উপনিষদ— সবখানেই এই গভীর রহস্য নিয়ে চিন্তা করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানও শত শত বছর ধরে উত্তর খুঁজছে এই সৃষ্টি তত্ত্ব নামক চিরকালীন রহস্যের। আশ্চর্যের বিষয়, বেদীয় আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি আর বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ— দুটি পথই মিলে যায় এক গভীর সত্যে।


নাসাদীয় সূক্ত : শূন্য থেকে সৃষ্টি

ঋগ্বেদের (১০.১২৯) নাসাদীয় সূক্তের প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে—

“নাসদাসীন্ নো সদাসীত্ তদানীং, নাসীদ্ রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।
কিমা বরিবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্ গহনং গভীরম্॥”

অর্থ :
“তখন ছিল না অস্তিত্ব, ছিল না অনস্তিত্ব;
ছিল না আকাশ, ছিল না অন্তরিক্ষ;
ছিল না মৃত্যু, ছিল না অমরত্ব;
ছিল কেবল এক অচিন শক্তি—
যেন গভীর জলের মতো অগম্য, অনন্ত।”

অর্থাৎ সৃষ্টির আগে কিছুই ছিল না। শুধু ছিল এক অজ্ঞেয় সত্তা, এক অসীম শক্তি, যা সবকিছুর সম্ভাবনা ধারণ করেছিল।


এক থেকে বহুত্ব :

পরের মন্ত্রে বেদ বলছে—

“তমা আসীত্ তমসা গূঢ়মগ্রে, অপ্রকেতং সালিলং সর্বমা ইদম্।
তুচ্ছ্যেনাভ্বপিহিতং যদাসীত্ তপসস্তন্মহিনা জায়তৈকম্॥”

অর্থ :
“অন্ধকার আচ্ছাদিত করেছিল অন্ধকারকে।
সবকিছু ছিল অজ্ঞেয় জলে নিমজ্জিত।
সেই গভীর শূন্যতার মধ্য থেকে
তপস্যার মহিমায় জন্ম নিল ‘এক’।”

এই “এক” সত্তাই বেদের মতে সৃষ্টির মূল, যেখান থেকে বহুত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

উপনিষদও একই কথা বলে—
ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে : “সদেব সোম্য ইদমগ্র আসীত্ একমেবাদ্বিতীয়ম্”—“হে সোম্য, এই জগৎ প্রথমে কেবল ‘সত্’ (অস্তিত্ব) ছিল; এক, আর দ্বিতীয় কিছু ছিল না।”


পুরুষ সূক্ত : মহাপুরুষ থেকে মহাবিশ্ব

ঋগ্বেদের আরেকটি সূক্ত (১০.৯০) বলছে, মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে মহাপুরুষের অঙ্গ থেকে—
 “তাঁর মুখ হলো ব্রাহ্মণ, বাহু হলো ক্ষত্রিয়, উরু হলো বৈশ্য, পা হলো শূদ্র। সূর্য, চন্দ্র, দিক, আকাশ— সবই তাঁর দেহ থেকে উদ্ভূত।”
এটি এক ধরনের প্রতীকী ভাষা, যা বোঝায় যে সমগ্র বিশ্ব এক চেতনার অঙ্গ।



আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি :

আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে ছিল এক সিঙ্গুলারিটি। সেখানে সময়, স্থান, পদার্থ— কিছুই ছিল না। হঠাৎ ঘটল এক মহাবিস্ফোরণ— বিগ ব্যাং।

প্রথম সেকেন্ডের ভগ্নাংশে জন্ম নিল মৌলিক কণিকা— কোয়ার্ক, ইলেকট্রন।

কয়েক মিনিটের মধ্যে তৈরি হলো হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস।

কয়েকশো মিলিয়ন বছর পরে গঠিত হলো প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি।

কোটি কোটি বছর ধরে নক্ষত্র বিস্ফোরণের ভেতর থেকে তৈরি হলো ভারী মৌল (লোহা, কার্বন ইত্যাদি), যা থেকে তৈরি হলো গ্রহ ও প্রাণের উপাদান।


অর্থাৎ, মহাবিশ্ব এসেছে এক রহস্যময় বিন্দু থেকে, আর ধাপে ধাপে প্রকাশ পেয়েছে আমাদের চির পরিচিত এই সুন্দর পৃথিবী।


চক্রাকার সৃষ্টি :

বেদ বলছে— সৃষ্টি ও প্রলয় এক অবিরাম চক্র। একবার সব সৃষ্টি হয়, আবার সব লীন হয়ে যায় শূন্যে।
আধুনিক বিজ্ঞানেও আজকাল “বিগ ক্রাঞ্চ” বা “বিগ বাউন্স” তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে— মহাবিশ্ব হয়তো একসময় সংকুচিত হয়ে আবার এক নতুন বিস্ফোরণে জন্ম নেবে।


রহস্যকে রহস্যই রাখা :

নাসাদীয় সূক্তের শেষ মন্ত্রে বলা হয়েছে—

“যো অস্যাধিক্শঃ পরমে ব্যোমন্ত্ সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ॥”

অর্থ :
“যিনি এই সৃষ্টি পরিচালনা করছেন,
তিনি হয়তো জানেন কীভাবে সবকিছুর শুরু হলো—
অথবা হয়তো তিনিও জানেন না।”

বেদের এই দৃষ্টিভঙ্গি আশ্চর্যভাবে বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায়। বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন— সিঙ্গুলারিটির আগে কী ছিল, আমরা জানি না; হয়তো জানার ক্ষমতাও নেই।


শেষের কথা :

বেদ বলছে— সৃষ্টি রহস্য অজ্ঞেয়, তবে সেই এক শক্তি থেকেই সবকিছু প্রকাশিত।
বিজ্ঞানও বলছে— সৃষ্টির শুরু এক অদ্ভুত বিন্দু থেকে, যার প্রকৃতি আজও অজানা।
বেদ আর বিজ্ঞান আসলে একই সুর তোলে ভিন্ন ভাষায়।

একটি বলে হৃদয়ের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে,
অন্যটি বলে গণিত আর পরীক্ষাগারের সূত্র দিয়ে।

কিন্তু সত্য একটাই—
এই মহাবিশ্ব এসেছে শূন্য থেকে,
আর সেই শূন্যের ভেতরেই লুকিয়ে আছে অসীমের আভাস।
যেমন শুরু, তেমনি শেষেও—
সব আবার মিলিয়ে যাবে সেই শূন্যে,
যেখান থেকে তার জন্ম।