Read Why to worship a human being? by DR RAJESH CHOUDHURI in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মানুষ পূজা

উনি তো একজন মানুষ, - বাকী আট দশটা মানুষের মতই আহার-নিদ্রা-মৈথুন নিয়ে জীবন নির্বাহ করছেন। উনার ফটো আসনে বসিয়ে আপনারা পূজা করেন কেন?" 

আমার ঠাকুরঘরের আসনে শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের প্রতিকৃতি লক্ষ করে আমার এক সহকর্মী  মন্তব্যটি করল।

 আমি তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,-" শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য উনারা তো মানুষই ছিলেন,- বাকী আট দশটা মানুষের মতই আহার নিদ্রা মৈথুন উনাদের জীবনেও ছিল,- উনাদের প্রতিকৃতি কারো বাড়ির ঠাকুরঘরের আসনে দেখতে পাননি কখনো? তাদেরও কি একই প্রশ্ন করেছেন?" 

" না না,- উনাদের সাথে কি তূলনা চলে? উনারা মানুষ হলেও ঈশ্বরীয় গুনসম্পন্ন ছিলেন। তাছাড়া উনারা কেউ তো জীবন্ত নেই এখন!!" 

বুঝতে পারলাম তিনি পুরোপুরি confused!! জিজ্ঞেস করলাম,-" ঈশ্বরীয় গুনসম্পন্ন মানে? ঈশ্বরীয় গুন কোনগুলি?" 

একটু চুপ থেকে ভেবে নিলেন যেন। বললেন,-" ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, ভগবান বুদ্ধ, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য উনারা সকলেই ছিলেন পরম ধার্মিক, দয়ালু, আদর্শপরায়ন, পরমজ্ঞানী, অকপট, প্রেমী, ন্যায়পরায়ণ, দায়ীত্ববান, শ্রদ্ধাশীল। এইগুলোই তো ঈশ্বরীয় গুন। " 

" আচ্ছা!! কিন্তু এগুলো তো সব মানবিক গুন,- আপনি যা যা গুনের কথা বললেন সবগুলো তো একজন মানুষের মধ্যেই প্রকাশিত হয়। 

তাছাড়া আপনি বললেন যে,- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র উনারা কেউ জীবিত নেই,- তাই উনাদের প্রতিকৃতি আসলে বসিয়ে পূজা করলে আপনার কোন আপত্তি নেই। তাই তো?" 

উনি আমতা আমতা করে বললেন,-" না,- মানে,- উনারা সবাই তো অনেক যুগ ধরে সমগ্র মানবজাতির নিকট পূজিত হয়ে আসছেন। সেটাই বলতে চাইছিলাম।" 

" আচ্ছা আচ্ছা!! বুঝতে পারলাম। আপনি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। ত্রেতাযুগে ভগবান রামচন্দ্রকে সামনে পেয়ে যদি হনুমান একই কথা বলত,-" উনি তো একজন মানুষ, - উনাকে কেন পূজা করব?"- তাহলে কেমনটা হত? যদি দ্বাপরযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সামনে পেয়ে অর্জুন তাঁকে গুরুরূপে পূজা করতে অস্বীকার করত,- তবে? শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে সামনে পেয়ে নরেন্দ্রনাথ যদি একজন সাধারণ মানুষ ভেবে অস্বীকার করত তবে কি তিনি স্বামী বিবেকানন্দ হতে পারতেন?

তাছাড়া কে বলল আপনাকে যে,- উনারা যুগ যুগ ধরে মানবসমাজে পূজিত হয়ে আসছেন? ত্রেতাযুগে রাবন, ইন্দ্রজিৎ, কৈকেয়ী, মন্থরা ইত্যাদি অনেকেই শ্রীরামচন্দ্রকে ঈশ্বর বলে মানতে পারেননি। দ্বাপরযুগে কংস, জরাসন্ধ, দুর্যোধন ইত্যাদি অনেকেই শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ মানুষ বলেই মনে করেছেন। এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত ব্যাক্তিও শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে চিনতে পারেননি। আপনার মত এমন মানুষ যুগে যুগেই ছিল,- যারা ঈশ্বরকোটি পুরুষকে সামনে পেয়েও চিনতে পারেনি,- বরং বিরোধিতা করেছে বারে বারে। "

 সহকর্মী যেন আমার কথা শুনে একটু বিরক্ত হলেন। " তার মানে আপনি আপনাদের আচার্য্যদেবকে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ উনাদের সাথে তূলনা করছেন?" 

" না না,- একদমই না। কারো সাথে কারো তূলনা চলেনা। শ্রীরামচন্দ্রের সাথে শ্রীকৃষ্ণের তূলনা চলেনা,- তেমনি শ্রীকৃষ্ণের সাথে শ্রীচৈতন্য বা শ্রীরামকৃষ্ণের তূলনা চলেনা৷ তেমনি তাঁদের কারো সাথে শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের তূলনা চলেনা। তাঁরা প্রত্যেকেই যার যার যুগ অনুযায়ী unique!   একেকজন একেক যুগ অনুযায়ী এবং একেক প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের কারো সাথে শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের তূলনা করে আমি নিজের মূর্খতার পরিচয় দেব না। " 

সহকর্মী যেন এইবার  আমায় প্যাঁচে ফেলার সুযোগ পেল!! " যদি আপনি আপনার আচার্য্যদেবকে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র আদি ঈশ্বরপুরুষদের মত মনে না করেন তাহলে আপনি উনার ছবি বসিয়ে পূজা করছেন কেন?"

 " আমি আপনার এই প্রশ্নের উত্তর একটু পরে দিচ্ছি। তার আগে আপনি একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। " -

" বলেন,- কি জিজ্ঞেস করবেন?" 

" আপনি শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র, ভগবান বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, - তাদের কাউকে নিজের চোখে দেখেননি, তাঁদের সাথে কথা বলেননি, তাঁদের সঙ্গ করেননি। বইয়ে পড়েছেন, লোকমুখে গল্প শুনেছেন, টিভিতে সিরিয়ালে হয়ত দেখেছেন। অর্থাৎ তাঁদের কারো চলা-বলা-করা সম্পর্কে আপনার প্রত্যক্ষ অনুভূতি নেই,- তবুও আপনি তাঁদের প্রত্যেককেই ঈশ্বর মেনে শ্রদ্ধাভক্তি করেন। আর,- আপনি যার ছবি আমার আসনে দেখে উনার সম্পর্কে প্রশ্ন করছেন,- আমরা লক্ষ লক্ষ লোক নিত্য উনার সঙ্গ করছি, উনার দৈনন্দিন জীবনচলনা প্রত্যক্ষ করছি, - তারপরও উনাকে আমরা শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে নিত্য পূজা করছি। বুঝতে পারছেন তো,- আপনার অনুভূতির চেয়ে আমাদের অনুভুতিটা কত বেশী প্রত্যক্ষ ও Authentic?

  আমাদের কথা বাদই দিন। আচার্য্যদেবের পরিবারের সদস্যগন,- উনার স্ত্রী, পুত্র, ভাই, বোন, ভাতৃবধূ প্রত্যেকেই যারা উনাকে খুব কাছ থেকে নিত্য প্রত্যক্ষ করছেন,- উনারা অব্দি উনাকে ঈশ্বরজ্ঞানে নিত্য পূজা করেন। এমন দৃশ্য বিশ্বের আর কোন পরিবারে দেখাতে পারেন? 

একজন মানুষ বাইরের জগতে ভাল ভাল কথা বলে, নাটক করে, প্রবচন শুনিয়ে মানুষের মনে শ্রদ্ধাভক্তির সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু নিজের পরিবারে চব্বিশ ঘন্টা থেকে পরিবারের সদস্যদের নিকট নিজের দোষত্রুটি লুকাতে পারেনা। যে মানুষটি নিজের স্ত্রী, পুত্র, ভাইবোনের নিকট ঈশ্বররূপে পূজিত হন,- সেই মানুষটিকে কতটা নিঁখুত চলনায় চলতে হয়,- তা বোধ করতে পারেন? 

কোন অলৌকিকতার গল্প না বলে, নিজেকে রঙচঙে না সাজিয়ে, খুব সাধারণ পোষাকে সাধারণভাবে সকলের সাথে চলে, প্রচন্ড বাস্তবতাকে আঁকরে ধরে কেউ যখন লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে পূজিত হয়,- তখন বুঝবেন সেই ব্যাক্তিটি সাধারণ মানুষ নন। মানবিক গুনের চরম প্রকাশ না থাকলে তা সম্ভব নয়।

 আমরা কেন উনাকে আসনে বসিয়ে পূজা করি,- তার কারন জানতে হলে আপনাকে উনার সঙ্গ করতে হবে, উনাকে সরাসরি কিছুদিন প্রত্যক্ষ করতে হবে। আপনি শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীরামকৃষ্ণ আদি ঈশ্বরকোটি পুরুষদের ঐশ্বরিক গুন বুঝাতে গিয়ে যে বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করলেন,- দয়া, সহানুভূতি, ধর্মাচারণ, প্রেম, দায়ীত্বশীলতা, শ্রদ্ধা ইত্যাদি গুনাবলী আমার আচার্য্যদেবের চলন চরিত্রে সত্য সত্য আছে কিনা,- তা জানতে হলে উনার সঙ্গ করতে হবে, উনার কাছে যেতে হবে। ফেইসবুক আর ইউটিউব দেখে উনার সম্পর্কে ধারনা সৃষ্টি করলে,- ভ্রান্তিতেই জড়াবেন। " 

ভদ্রমহিলা যেন তর্ক করতেই কথা জুড়েছেন। জানার আগ্রহের চেয়ে তর্কে জেতার চেষ্টাটাই বেশী। তাই একটু চুপ থেকে আবার বলে উঠলেন,-" এমন কত কত স্বঘোষিত বাবা, স্বামী ও গুরুদেরই আজকাল দেখা যায় যাদেরকে লক্ষ লক্ষ শিষ্যরা পূজা করে,- কিন্তু তাদের অনেকেই আজকাল নানা কুকান্ডে জড়িয়ে জেলের ভাত খাচ্ছে।" 

আমার মেজাজটা একটু গরমই হল,- উনার কথার ধরন দেখে। বললাম,-" থুতনিতে দাড়ি আছে বলেই আপনি যদি রামছাগল এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একই গোত্রের ভেবে থাকেন,- সেটা আপনার বোধের দোষ, - রামছাগলের কোন দোষ নেই।

আপনি আমার আসনে যার ছবি দেখে এই কথাগুলো বলছেন,- তিনি কখনো নিজেকে গুরু বা স্বামী বলেননা। বরং তিনি নিজেকে শ্রীশ্রীঠাকুরের একান্ত সেবক হিসাবেই পরিচয় দেন। তিনি কখনো  অলৌকিকতা বা বুজরুকির কথা বলেননা। নিজের মহত্ব প্রচার করেননা। নিজেকে জাহির করেননা। খুব সাধারণ ধুতি ফতোয়া পড়ে সারাদিন মানুষের মাঝে বসে তাদের সুখদুঃখের কথা শুনেন,- অত্যন্ত সাধারণ অনাড়ম্বর জীবন তাঁর। 

নিজেকে নানা অলংকার বা বাহারী রঙবেরঙের কাপড়ে সুসজ্জিত করে উঁচু সিংহাসনে বসে তিনি নিজেকে প্রচার করেননা। আপনি যে বাবা বা স্বামীদের কথা বলছেন,- তারা মানুষের বৃত্তিতে তেল মেরে নিজের প্রচার করেন, কোনকিছু না করে অনেককিছু প্রাপ্তির প্রলোভন দেখান। তাই এত ভীড় তাদের কাছে।

রোজ ঘুম থেকে উঠে প্রত্যাশাহীনভাবে গুরুর ভোগের জন্য ইষ্টভৃতি নিবেদন করতে হবে, সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনা করতে হবে, সাত্ত্বিক আহার করতে হবে, নেশাভাঙ্গ ছাড়তে হবে, নিজের কাজকর্ম-আমোদপ্রমোদ ফেলে ঘরে ঘরে গিয়ে ডিপি ওয়ার্ক করতে হবে, বর্ন বংশ গোত্র মিলিয়ে বিয়ে করতে হবে, রোজ ব্রাম্মমুহুর্তে ধ্যান করতে হবে কিন্তু গুরুর কাছে কিছু চাওয়া যাবেনা,- এই ধরনের অনুশাসনগুলি একবার শিষ্যদের উপর চাপিয়ে দেখুক,- কতজন মানুষ প্রবচন শুনার জন্য ভীড় করে!!"

 ভদ্রমহিলা চুপ করে আছেন। আমি পুনরায় বললাম,-" আমার সাথে তো আপনার এতদিনের পরিচয়,- আমার সম্পর্কে আপনার কি ধারনা? আমাকে আপনি সম্মান করেন কেন? আমাকে কখনো নেশাভাঙ্গ করতে দেখেননি, কারো সাথে প্রতারনা-কপটতা করতে দেখেননি, কারো সাথে অভদ্রতা করতে দেখেননি, কারো ক্ষতি করতে দেখেননি,- বরং যতটুকু সম্ভব মানুষের উপকার করারই চেষ্টা করি। আমার স্বভাবে চরিত্রে কোন কুভাব দেখলে কি আপনি আমায় সম্মান করতেন? আমার সম্পর্কে যদি আপনার সসম্মানজনক ধারনা জন্মিয়ে থাকে,- তাহলে আমি যাকে আসনে বসিয়ে পূজা করি, যাকে অনুসরণ করি,- তাঁর সাথে ঐসব স্বঘোষিত বাবা ও স্বামীদের তূলনা করেন কিভাবে? এতটুকু বোধবুদ্ধি না থাকলে আপনি নিজের মা বাবাকেই তো সম্মান করতে পারবেন না। " ভদ্রমহিলা  বোধহয় বুঝতে পারলেন,- আমার মেজাজ বিগরে গেছে। আর কথা বাড়াননি।