Read Story of Mahabharat Part 139 Death of Dronacharyya on 16th day by Ashoke Ghosh in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 139

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৩৯

ষোড়শ দিনের যুদ্ধে দ্রোণাচার্যের মৃত্যু

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ষোড়শ দিনের যুদ্ধে দ্রোণাচার্যের মৃত্যু

দ্রোণের বাণবর্ষণে বহু পাণ্ডবসেনা নিহত হচ্ছে দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, হাতে ধনুর্বাণ থাকলে দ্রোণ ইন্দ্রাদি দেবগণেরও অজেয়, কিন্তু যদি অস্ত্র ত্যাগ করেন তবে মানুষও ওঁকে বধ করতে পারে। তোমরা এখন ধর্মের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে জয়ের উপায় স্থির করো, নতুবা দ্রোণই তোমাদের সকলকে বধ করবেন। আমার মনে হয়, অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ পেলে উনি আর যুদ্ধ করবেন না, অতএব কেউ ওঁকে বলুক যে অশ্বত্থামা যুদ্ধে হত হয়েছেন।

কৃষ্ণের এই প্রস্তাব অর্জুনের পছন্দ হোলো না, কিন্তু আর সকলেই এতে মত দিলেন, যুধিষ্ঠিরও নিতান্ত অনিচ্ছায় সম্মত হলেন। মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামে একটি হাতি ছিলো। ভীম তাকে গদাঘাতে বধ করলেন এবং দ্রোণের কাছে গিয়ে লজ্জিতভাবে চিৎকার কোরে বললেন, অশ্বত্থামা হত হয়েছে। ভীমের সেই কথা শুনে দ্রোণের শরীর অবশ হোলো। কিন্তু তিনি পুত্রের বীরত্ব জানতেন, সেজন্য ভীমের কথায় অধীর হলেন না, ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর তীক্ষ্ম বাণ ক্ষেপণ করতে লাগলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের রথ ও সমস্ত অস্ত্র বিনষ্ট হোলো, তখন ভীম তাঁকে নিজের রথে তুলে নিয়ে বললেন, তুমি ভিন্ন আর কেউ আচার্যকে বধ করতে পারবে না, তোমার উপরেই এই ভার আছে, অতএব শীঘ্র ওঁকে মারবার চেষ্টা করো।

দ্রোণ ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। বিশ হাজার পাঞ্চাল রথী, পাঁচ শত মৎস্য সৈন্য, ছয় হাজার সৃঞ্জয় সৈন্য, দশ হাজার হাতি এবং দশ হাজার ঘোড়া বিনষ্ট হোলো। এই সময়ে বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, বশিষ্ঠ প্রভৃতি মহর্ষিগণ অগ্নিদবেকে সামনে রেখে সূক্ষ্মদেহে উপস্থিত হয়ে দ্রোণকে বললেন তুমি বেদবিৎ ব্রাহ্মণ, এরূপ নিষ্ঠুর কাজ করা তোমার উচিত নয়। যারা ব্রহ্মাস্ত্রে অনভিজ্ঞ এমন লোকদেরকে তুমি ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে মারছ, এই পাপকর্ম আর কোরো না, শীঘ্র অস্ত্র ত্যাগ করো।

যুদ্ধে বিরাম দিয়ে দ্রোণ বিষগ্নমনে যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করলেন, অশ্বত্থামা হত হয়েছেন কিনা। দ্রোণের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ত্রিলোকের ঐশ্বর্যের জন্যও যুধিষ্ঠির মিথ্যা বলবেন না। কৃষ্ণ উদ্বিগ্ন হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দ্রোণ যদি আর অর্ধেক দিন যুদ্ধ করেন তবে আপনার সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট হবে। আমাদের রক্ষার জন্য এখন আপনি সত্য না বলে মিথ্যাই বলুন, জীবনরক্ষার জন্য মিথ্যা বললে পাপ হয় না। ভীম বললেন, মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামে একটা হাতি ছিলো, তাকে আমি বধ করেছি। তারপর আমি দ্রোণকে বললাম, অশ্বত্থামা হত হয়েছেন, আপনি যুদ্ধ থেকে বিরত হন, কিন্তু উনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। মহারাজ, আপনি কৃষ্ণের কথা শুনুন, দ্রোণকে বলুন যে অশ্বত্থামা মরেছেন। আপনি বললে দ্রোণ আর যুদ্ধ করবেন না।

কৃষ্ণের প্ররোচনায়, ভীমের সমর্থনে এবং দ্ৰোণবধের ভবিতব্যতা জেনে যুধিষ্ঠির সম্মত হলেন। তাঁর অসত্যভাষণের ভয় ছিল, জয়লাভেরও আগ্রহ ছিল। তাই তিনি চিৎকার কোরে বললেন, অশ্বত্থামা হত হয়েছেন তার পর অস্পষ্ট স্বরে বললেন ওই নামের হাতি। যুধিষ্ঠিরের রথ আগে ভূমি থেকে চার আঙুল উপরে শূণ্যে থাকত, এই মিথ্যা বলার পাপে তার বাহনসকল ভূমি স্পর্শ করলো।

মহর্ষিদের কথা শুনে দ্রোণের ধারণা জন্মেছিল যে তিনি পাণ্ডবদের নিকট অপরাধী হয়েছেন। এখন তিনি পুত্রের মৃত্যুসংবাদে শোকে অভিভূত এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে আর যুদ্ধ করতে পারলেন না। এই সময়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি দীর্ঘ ধনুতে সাপের বিষের মতো বাণ দ্রোণের উপর নিক্ষেপ করলেন। দ্রোণ সেই বাণ নিবারণের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার উপযুক্ত অস্ত্র তার মনে পড়ল না। দ্রোণের কাছে গিয়ে ভীম ধীরে ধীরে বললেন, যে হীন ব্রাহ্মণগণ স্বধর্মে না থেকে অস্ত্রশিক্ষা করেছে, তারা যদি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতো তবে ক্ষত্রিয়কুল ক্ষয় পেত না। এই সৈন্যরা নিজের বৃত্তি অনুসারে যুদ্ধ করছে, কিন্তু আপনি অব্রাহ্মণের বৃত্তি নিয়ে এক পুত্রের জন্য বহু প্রাণী বধ করছেন, আপনার লজ্জা হচ্ছে না কেন? যার জন্য আপনি অস্ত্রধারণ কোরে আছেন, যাঁর অপেক্ষায় আপনি জীবিত আছেন, সেই পুত্র আজ রণভূমিতে শুয়ে আছে। ধর্মরাজের বাক্যে আপনি সন্দেহ করতে পারেন না।

 দ্রোণ তার ধনু ত্যাগ কোরে বললেন, কর্ণ, কৃপ, দুর্যোধন, তোমরা যথাশক্তি যুদ্ধ করো, পাণ্ডবদের আর তোমাদের মঙ্গল হোক, আমি অস্ত্র ত্যাগ করলাম। এই বলে তিনি চিৎকার কোরে অশ্বত্থামাকে ডাকলেন, তার পর সমস্ত অস্ত্র রথের মধ্যে রেখে যোগস্থ হয়ে সর্বপ্রাণীকে অভয় দিলেন। এই সুযোগে ধৃষ্টদ্যুম্ন তার রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং খড়্গ নিয়ে দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। দুই পক্ষের সৈন্যরা হাহাকার কোরে উঠল। দ্রোণ যোগমগ্ন হয়ে চোখ বন্ধ কোরে পরমপুরুষ বিষ্ণুকে ধ্যান করতে লাগলেন এবং ব্রহ্মস্বরূপ একাক্ষর ॐ মন্ত্র স্মরণ করতে করতে ব্রহ্মলোকে যাত্রা করলেন। মৃত্যুকালে তার দেহ থেকে দিব্য জ্যোতি নির্গত হয়ে উল্কার ন্যায় নিমেষের মধ্যে অন্তর্হিত হোলো। দ্রোণের এই ব্রহ্মলোকযাত্রা কেবল পাঁচজন দেখতে পেলেন -কৃষ্ণ, কৃপ, যুধিষ্ঠির, অর্জুন ও সঞ্জয়।

দ্রোণ রক্তাক্ত দেহে নিরস্ত্র হয়ে রথে বসে আছেন দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর প্রতি ধাবিত হলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন, আচার্যকে জীবিত ধরে আনো, বধ কোরো না’— চিৎকার কোরে এই বলে অর্জুন তাকে নিবারণ করতে গেলেন, তথাপি ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রাণহীন দ্রোণের চুল ধরে শিরচ্ছেদ করলেন এবং গর্জন করতে লাগলেন। তার পর তিনি দ্রোণের মুণ্ড তুলে নিয়ে কৌরবসৈন্যদের সামনে নিক্ষেপ করলেন।

দ্রোণের মৃত্যুর পর কৌরবসৈন্য ছত্রভঙ্গ হোলো। কুরুপক্ষের রাজারা দ্রোণের মৃতদেহ রণস্থলে খুঁজতে থাকলেন, কিন্তু দেখতে পেলেন না। ধৃষ্টদ্যুম্নকে আলিঙ্গন করে ভীম বললেন, কর্ণ আর পাপী দুর্যোধন নিহত হোলে আবার তোমাকে আলিঙ্গন করবো।

______________

(ক্রমশ)