Read Story of Mahabharat Part 140 Promise of Ashwatthama and quarrel between Dhristadyumna and Satyaki by Ashoke Ghosh in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 140

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৪০

অশ্বত্থামার সংকল্প এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন-সাত্যকির বিবাদ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

অশ্বত্থামার সংকল্প এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন-সাত্যকির বিবাদ

দ্রোণের মৃত্যুর পর কৌরবগণ ভীত হয়ে পালাতে লাগলেন। কর্ণ, শল্য, কৃপ, দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রভৃতি রণস্থল থেকে চলে এলেন। অশ্বত্থামা তখনও শিখণ্ডী প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। কৌরবসৈন্যদের পালাতে দেখে তিনি দুর্যোধনের কাছে এসে বললেন, তোমার সৈন্য পালাচ্ছে কেন? তোমাকে এবং কর্ণ প্রভৃতিকে স্বাভাবিক দেখছি না, কোন মহারথ নিহত হয়েছেন ? দুর্যোধন অশ্বত্থামার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না, তার চোখ অশ্রূপূর্ণ হোলো। তখন কৃপাচার্য দ্রোণের মৃত্যুর বৃত্তান্ত জানালেন। অশ্বত্থামা বারবার চোখ মুছে ক্রোধে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার পিতা অস্ত্র ত্যাগ করার পর নীচাশয় পাণ্ডবগণ যেভাবে তাকে বধ করেছে এবং নৃশংস অনার্য যুধিষ্ঠির যে পাপকর্ম করেছে তা শুনলাম। ন্যায়যুদ্ধে নিহত হওয়া দুঃখজনক নয়, কিন্তু সকল সৈন্যের সামনে পিতার চুল ধরা হয়েছে, এতে আমি মর্মান্তিক কষ্ট পাচ্ছি। নৃশংস দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন শীঘ্রই এর দারুণ প্রতিফল পাবে। যে মিথ্যাবাদী পাণ্ডব আচার্যকে অস্ত্রত্যাগ করিয়েছে, আজ রণভূমি সেই যুধিষ্ঠিরের রক্ত পান করবে। আমি এমন কাজ করবো যাতে পরলোকগত পিতার নিকট ঋণমুক্ত হতে পারি। আমার কাছে যে অস্ত্র আছে তা পাণ্ডবগণ, কৃষ্ণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী বা সাত্যকি কেউ জানেন না। আমার পিতা নারায়ণের পূজা কোরে এই অস্ত্র পেয়েছিলেন। অস্ত্রদানের সময় নারায়ণ বলেছিলেন, এই অস্ত্র সহসা প্রয়োগ করবে না। শত্ৰুসংহার না কোরে এই অস্ত্র নিবৃত্ত হয় না। এতে কে নিহত হবে তা পূর্বে জানা যায় না, যারা অবধ্য তারাও নিহত হতে পারে। কিন্তু রথ ও অস্ত্র ত্যাগ কোরে শরণাগত হলে এই মহাস্ত্র থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। আজ আমি সেই নারায়ণ অস্ত্র দিয়ে পাণ্ডব, পাঞ্চাল, মৎস্য ও কেকয়গণকে বিনষ্ট করবো। গুরুহত্যাকারী পাপিষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুম্ন আজ রক্ষা পাবে না।

অশ্বত্থামার এই কথা শুনে কৌরবসৈন্য আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এলো, কৌরবশিবিরে শঙ্খ ও রণবাদ্য বাজতে লাগল। অশ্বত্থামা জলস্পর্শ কোরে নারায়ণ অস্ত্র প্রকাশিত করলেন। তখন প্রবল বেগে বাতাস বইতে লাগল, পৃথিবী কম্পিত ও মহাসাগর তরঙ্গসঙ্কুল হোলো, নদীস্রোত বিপরীতগামী হোলো, সূর্য নিস্তেজ হলেন।

কৌরবশিবিরে তুমুল শব্দ শুনে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, দ্রোণাচার্যের নিধনের পর কৌরবরা হতাশ হয়ে রণস্থল থেকে পালিয়েছিল, এখন আবার ওদের ফিরিয়ে আনল কে? ওদের মধ্যে ওই লোমহর্ষকর গর্জন হচ্ছে কেন? অর্জুন বললেন, অশ্বত্থামা গর্জন করছেন। তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েই উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়ার মতো আওয়াজ করেছিলেন সেজন্য তাঁর নাম অশ্বত্থামা। ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার গুরুর চুল ধরেছিলেন, অশ্বত্থামা তা ক্ষমা করবেন না। মহারাজ, আপনি ধর্মজ্ঞ হয়েও রাজ্যলাভের জন্য মিথ্যা বলে মহাপাপ করেছেন। বালিবধের জন্য রামের যেমন অকীর্তি হয়েছে সেইরূপ দ্রোণবধের জন্য আপনার চিরস্থায়ী অকীর্তি হবে। এই পাণ্ডুপুত্র সর্বধর্মসম্পন্ন, এ আমার শিষ্য, এ মিথ্যা বলবে না — আপনার উপর দ্রোণের এই বিশ্বাস ছিলো। আপনি অস্ত্ৰত্যাগী গুরুকে অধর্ম অনুসারে হত্যা করিয়েছেন, এখন যদি পারেন তো সকলে মিলে ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করুন। যিনি সর্বভূতে মহা শক্তিমান বলে গণ্য সেই অতিমানব অশ্বত্থামা পিতার অন্যায় ভাবে হত্যার কারণে আজ আমাদের সংহার করবেন। আমাদের বয়সের অধিকাংশই অতীত হয়েছে, এখন যে অল্পকাল অবশিষ্ট আছে তা অধর্মাচরণের জন্য বিকারগ্রস্ত হোলো। যিনি স্নেহের জন্য এবং ধর্মত পিতার তুল্য ছিলেন, অল্প কাল রাজ্যভোগের লোভে তাকে আমরা হত্যা করিয়েছি। হায়, আমরা মহাপাপ করেছি!

ভীম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, অর্জুন, তুমি অরণ্যবাসী ব্রতধারী মুনির ন্যায় ধর্মকথা বলছ। কৌরবগণ অধর্ম অনুসারে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্য হরণ করেছে, দ্রৌপদীর চুল ধরে টেনেছে, আমাদের তেরো বছর নির্বাসিত করেছে। এখন আমরা সেইসকল অন্যায়ের প্রতিশোধ নিচ্ছি। তুমি ক্ষত্রধর্ম না বুঝে আমাদের ক্ষতস্থানে লবণ দিচ্ছ। তোমরা চার ভাই না হয় যুদ্ধ করো না, আমি একাই গদাহাতে অশ্বত্থামাকে জয় করবো।

ধৃষ্টদ্যুম্ন অর্জুনকে বললেন, ব্রাহ্মণদের কাজ যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপন, দান ও প্রতিগ্রহ। দ্রোণ তার কি করেছেন? তিনি স্বধর্ম ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়বৃত্তি নিয়ে অলৌকিক অস্ত্রে আমাদের ধ্বংস করছিলেন। সেই নীচ ব্রাহ্মণকে যদি আমরা কুটিল উপায়ে বধ করে থাকি তবে কি অন্যায় হয়েছে? দ্রোণকে মারবার জন্যই যজ্ঞাগ্নি থেকে দ্রুপদপুত্ররূপে আমার জন্ম। সেই নৃশংসকে আমি নিপাতিত করেছি। তুমি জয়দ্রথের মুণ্ড নিষাদের দেশে নিক্ষেপ করেছিলে, কিন্তু আমি দ্রোণের মুণ্ড সেরূপে নিক্ষেপ করিনি, এই আমার দুঃখ। ভীষ্মকে বধ করলে যদি অধর্ম না হয় তবে দ্রোণের বধে অধর্ম হবে কেন? অর্জুন, জ্যেষ্ঠপাণ্ডব মিথ্যাবাদী নন, আমিও অধার্মিক নই, আমরা শিষ্যদ্রোহী পাপীকেই মেরেছি।

ধৃষ্ঠদ্যুম্নের কথা শুনে অর্জুন বললেন, ধিক ধিক! যুধিষ্ঠিরাদি, কৃষ্ণ এবং আর সকলে লজ্জিত হলেন। সাত্যকি বললেন, এখানে কি এমন কেউ নেই যে এই কটুভাষী নরাধম ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করে? ক্ষুদ্রমতি, তোমার জিহ্বা আর মস্তক বিদীর্ণ হচ্ছে না কেন? কুলাঙ্গার, গুরুহত্যা কোরে তোমার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সাত পুরুষকে তুমি নরকস্থ করেছ। ভীষ্ম নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দিয়েছিলেন এবং অেমার ভাই শিখণ্ডীই তাকে বধ করেছে। তুমি যদি আবার এমন কথা বলো তবে গদাঘাতে তোমার মাথা চূর্ণ করবো।

সাত্যকির ভর্ৎসনা শুনে ধৃষ্টদ্যুম্ন হেসে বললেন, তেমার কথা শুনেছি, ক্ষমাও করেছি। সাত্যকি, তুমি সর্বতোভাবে নিন্দনীয়, তথাপি আমার নিন্দা করছ! সকলে বারণ করলেও তুমি অনশনে ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবার শিরচ্ছেদ করেছিলে। তার চেয়ে পাপকর্ম আর কি হতে পারে ? ধৃষ্টদ্যুম্নের তিরস্কার শুনে সাত্যকি বললেন, আমি আর কিছু বলতে চাই না, তুমি বধের যোগ্য, তোমাকে বধ করবো। এই বলে সাত্যকি গদা নিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ধাবিত হলেন, তখন কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম সাত্যকিকে জড়িয়ে ধরে নিরস্ত করলেন। সহদেব মিষ্টবাক্যে বললেন, নরশ্রেষ্ঠ সাত্যকি, অন্ধক বৃষ্ণি ও পাঞ্চাল ভিন্ন আমাদের মিত্র নেই। আপনারা, আমরা এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন সকলেই পরস্পরের মিত্র, অতএব ক্ষমা করুন। ধৃষ্টদ্যুম্ন সহাস্যে বললেন, ভীম, শিনির পৌত্রটাকে ছেড়ে দাও, আমি তীক্ষ্ম শরের আঘাতে ওর ক্রোধ, যুদ্ধের ইচ্ছা আর জীবন শেষ করে দেবো, ও মনে করেছে আমি ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবা।

সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের মতো গর্জন করতে লাগলেন, তখন কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির অনেক চেষ্টায় তাদের শান্ত করলেন।

______________

(ক্রমশ)