মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৪১
অশ্বত্থামার নারায়ণ অস্ত্র প্রয়োগ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
অশ্বত্থামার নারায়ণ অস্ত্র প্রয়োগ
পিতা দ্রোণাচার্যকে অন্যায় ভাবে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রলয়কালে যমের ন্যায় অশ্বত্থামা পাণ্ডবসৈন্য সংহার করতে লাগলেন। তার নারায়ণ অস্ত্র থেকে হাজার হাজার বিষাক্ত সাপের তুল্য বাণ, লোহার গোলক, শতঘ্নী, শূল, গদা ও ক্ষুরধার চক্র নির্গত হোলো, পাণ্ডবসৈন্য শুকনো ঘাসের রাশির পুড়ে যাওয়ার মতো বিনষ্ট হতে থাকল। সৈন্যগণ আতঙ্কিত হয়ে পালাচ্ছে এবং অর্জুন উদাসীন হয়ে আছেন দেখে যুধিষ্ঠির বললেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, তুমি পাঞ্চাল সৈন্য নিয়ে পালাও। সাত্যকি, তুমি বৃষ্ণি ও অন্ধক সৈন্য নিয়ে ফিরে যাও। কৃষ্ণ যা কর্তব্য মনে করেন করবেন। আমি সকল সৈন্যকে বলছি যুদ্ধ কোরো না, আমি ভাইদের সঙ্গে আগুনে প্রবেশ করবো। ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো দুস্তর সাগর পার হয়ে এখন আমরা অশ্বত্থামার মতো ক্ষুদ্র জলাশয়ে ডুবে মরবো। আমি শুভাকাঙ্ক্ষী আচার্যকে হত্যা করিয়েছি, অতএব অর্জুনের ইচ্ছা পূর্ণ হোক। এই দ্রোণ যুদ্ধে অপটু বালক অভিমন্যুকে হত্যা করিয়েছেন। পাশা খেলার সভায় নিগৃহীত দ্রৌপদীর প্রশ্ন শুনে নীরব ছিলেন। পরিশ্রান্ত অর্জুনকে মারবার জন্য দুর্যোধন যখন যুদ্ধে যায় তখন ইনিই তার দেহে অক্ষয় কবচ বেঁধে দিয়েছিলেন। ব্রহ্মাস্ত্রে অনভিজ্ঞ পাঞ্চালগণকে ইনি ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে বিনাশ করেছিলেন। কৌরবগণ যখন আমাদের নির্বাসিত করে তখন ইনি আমাদের যুদ্ধ করতে দেননি, আমাদের সঙ্গে বনেও যাননি। আমাদের সেই পরম সুহৃৎ দ্রোণাচার্য নিহত হয়েছেন, অতএব আমরাও সবান্ধবে প্রাণত্যাগ করবো।
কৃষ্ণ সত্বর এসে দুই হাত তুলে সৈন্যগণকে বললেন, তোমরা শীঘ্র অস্ত্রত্যাগ করো, বাহন থেকে নেমে এসো, নারায়ণ অস্ত্র নিবারণের এই উপায়। ভীম বললেন, কেউ অস্ত্রত্যাগ কোরো না, আমি শরাঘাতে অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবারিত করবো। এই বলে তিনি রথারোহণে অশ্বত্থামার দিকে ধাবিত হলেন। অশ্বত্থামাও হাসতে হাসতে ভয়ঙ্কর বাণে ভীমকে আচ্ছন্ন করলেন।
পাণ্ডবসৈন্য অস্ত্র পরিত্যাগ কোরে হাতি, ঘোড়া ও রথ থেকে নেমে পড়ল, তখন অশ্বত্থামার নারায়ণ অস্ত্র কেবল ভীমের দিকে যেতে লাগল। কৃষ্ণ ও অর্জুন সত্বর রথ থেকে নেমে ভীমের কাছে গেলেন। কৃষ্ণ ভীমকে বললেন, এ কি করছ? বারণ করলেও যুদ্ধ থেকে শুনছ না কেন? যদি আজ জয়ী হওয়া সম্ভবপর হতো তবে আমরা সকলেই যুদ্ধ করতাম। দেখো, পাণ্ডবপক্ষের সকলেই রথ থেকে নেমেছে। এই বলে কৃষ্ণ ও অর্জুন সবলে ভীমকে রথ থেকে নামালেন এবং তার অস্ত্র কেড়ে নিলেন। ভীম ক্রোধে চোখ লাল কোরে সাপের মতো নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন, নারায়ণ অস্ত্রও নিবৃত্ত হোলো।
পাণ্ডবসৈন্য আবার যুদ্ধে উদ্যত হয়েছে দেখে দুর্যোধন বললেন, অশ্বত্থামা, আবার অস্ত্র প্রয়োগ করো। অশ্বত্থামা বিষণ্ণ হয়ে বললেন, এই নারায়ণ অস্ত্র দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করলে প্রয়োগকারীকেই বধ করে। নিশ্চয় কৃষ্ণ পাণ্ডবগণকে এই অস্ত্র নিবারণের উপায় বলেছেন, নতুবা আজ সমস্ত শত্রু ধ্বংস হতো। তখন দুর্যোধনের অনুরোধে অশ্বত্থামা অন্য অস্ত্র নিয়ে আবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে পরাস্ত করে মালবরাজ সুদর্শন, পুরুবংশীয় বৃদ্ধক্ষত্র ও চেদি দেশের যুবরাজকে বধ করলেন। তার পর তিনি অর্জুনের দিকে ভয়ংকর আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করলে অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে অশ্বত্থামার অস্ত্র ব্যর্থ করে দিলেন।
এই সময়ে মহর্ষি বেদব্যাস আবির্ভূত হলেন। অশ্বত্থামা কাতর হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার অস্ত্র ব্যর্থ হোলো কেন? কৃষ্ণ ও অর্জুনের মায়ায় না দৈব কারণে এমন হোলো? কৃষ্ণ ও অর্জুন মানুষ হয়ে আমার অস্ত্র থেকে কি করে নিস্তার পেলেন?
ব্যাসদেব বললেন, স্বয়ং নারায়ণ মায়ার দ্বারা জগৎ মোহিত করে কৃষ্ণরূপে বিচরণ করছেন। তাঁর তপস্যার ফলে তাঁরই তুল্য নর-ঋষি অর্জুন রূপে জন্মেছেন। অশ্বত্থামা, তুমিও রুদ্রের অংশে জন্মেছ। কৃষ্ণ, অর্জুন ও তোমার অনেক জন্ম হয়ে গেছে, তোমরা বহু কর্ম যোগ ও তপস্যা করেছ, যুগে যুগে কৃষ্ণ ও অর্জুন শিবলিঙ্গের পূজা করেছেন, তুমিও শিবপ্রতিমার পূজা করেছ। কৃষ্ণ রুদ্রের ভক্ত এবং রুদ্র হতেই তার উৎপত্তি।
ব্যাসের কথা শুনে অশ্বত্থামা রুদ্রকে নমস্কার করলেন এবং কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেন। তিনি রোমাঞ্চিত দেহে মহর্ষি বেদব্যাসকে অভিবাদন কোরে কৌরবগণের নিকট ফিরে গেলেন। সে দিনের যুদ্ধ শেষ হোলো।
______________
(ক্রমশ)