মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৪২
মহাদেবের মহিমা এবং কর্ণের সেনাপতিত্বে অভিষেক
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
মহাদেবের মহিমা এবং কর্ণের সেনাপতিত্বে অভিষেক
বেদব্যাসকে দেখে অর্জুন বললেন, আমি যুদ্ধ করবার সময় দেখেছি এক অগ্নিপ্রভ পুরুষ প্রদীপ্ত শূল নিয়ে আমার আগে আগে যাচ্ছেন এবং যে দিকে যাচ্ছেন সেই দিকেই শত্রুরা পরাজিত হচ্ছে। তাঁর পা ভূমি স্পর্শ করে না, তিনি শূলও নিক্ষেপ করেন না, অথচ তার শূল থেকে হাজার হাজার শূল নিক্ষিপ্ত হয়, তার প্রভাবেই শত্রু পরাজিত হয়, কিন্তু লোকে মনে করে আমিই পরাজিত করেছি। এই শূলধারী পুরুষশ্রেষ্ঠ কে তা বলুন। বেদব্যাস বললেন, অর্জুন, তুমি মহাদেবকে দেখেছ। তিনি প্রজাপতিগণের প্রধান, সর্বলোকেশ্বর, ঈশান, শিব, শংকর, ত্রিলোচন, রুদ্র, হর, স্থাণু, শম্ভু, স্বয়ম্ভু, ভূতনাথ, বিশ্বেশ্বর, পশুপতি, সর্ব, ধূর্জটি, বৃষধ্বজ, মহেশ্বর, পিনাকী, ত্র্যম্বক নামেও পরিচিত। তার বহু পারিষদ আছেন, তাদের নানা রূপ - বামন, জটাধারী, মুণ্ডিত মস্তক, মহোদর, মহাকায়, মহাকর্ণ, বিকৃতমুখ, বিকৃতচরণ, বিকৃতকেশ। তিনিই যুদ্ধে তোমার আগে আগে যান। তুমি তার শরণাপন্ন হও। প্রাচীন কালে প্রজাপতি দক্ষ এক যজ্ঞ করেছিলেন, মহাদেবের ক্রোধে তা পণ্ড হয়। পরিশেষে দেবতারা তাকে প্রণিপাত করে তার শরণাপন্ন হলেন এবং তার জন্য বিশিষ্ট যজ্ঞভাগ নির্দিষ্ট করে দিলেন। তখন মহাদেব প্রসন্ন হলেন। পুরাকালে কমলাক্ষ, তারকাক্ষ ও বিদ্যুন্মালী নামে তিন অসুর ব্রহ্মার নিকট বর পেয়ে সুবিশাল তিন বিমানে আকাশে ঘুরে বেড়াত। এই বিমানের একটি স্বর্ণময়, একটি রজতময় আর একটি লৌহময়। এই ত্রিপুরাসুরের উপদ্রবে পীড়িত হয়ে দেবতারা মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। মহাদেব ত্রিশূলের আঘাতে সেই ত্রিপুর বিনষ্ট করলেন। সেই সময়ে ভগবতী উমা পঞ্চশিখাযুক্ত একটি বালককে কোলে নিয়ে দেবগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই বালক? ইন্দ্র ঈর্ষাবশতঃ বালকের উপর বজ্রপ্রহার করতে গেলে মহাদেব ইন্দ্রের বাহু অবশ করে দিলেন। তার পর পিতামহ ব্রহ্মা মহেশ্বরকে শ্রেষ্ট জেনে বন্দনা করলেন, দেবতারাও রুদ্র ও উমাকে প্রসন্ন করলেন। তখন ইন্দ্রের বাহু পূর্ববৎ হোলো। অর্জুন, আমি হাজার বছরেও মহাদেবের সমস্ত গুণ বর্ণনা করতে পারি না। বেদে এঁর শতরুদ্রিয় স্তোত্র এবং অনন্তরুদ্র নামে উপাসনামন্ত্র আছে। জয়দ্ৰথবধের পূর্বে তুমি কৃষ্ণের কৃপায় স্বপ্নযোগে এই মহাদেবকেই দেখেছিলে। তুমি যাও, যুদ্ধ করো, তোমার পরাজয় হবে না, মন্ত্রী ও রক্ষক রূপে স্বয়ং কৃষ্ণ তোমার সঙ্গে রয়েছেন।
দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা মনে করেছিলেন যে নারায়ণ অস্ত্র দিয়ে সমস্ত পাণ্ডববাহিনী ধ্বংস করবেন। তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হোলো। সন্ধ্যাকালে দুর্যোধন যুদ্ধবিরতির আদেশ দিয়ে নিজ শিবিরে ফিরে এলেন। তিনি সুখশয্যায় উপবিষ্ট হয়ে স্বপক্ষীয় মহাধনুর্ধরগণকে মিষ্টির কথায় অনুনয় কোরে বললেন, হে বুদ্ধিমান রাজগণ, আপনারা অবিলম্বে নিজের নিজের মত বলুন, এ অবস্থায় আমার কি করা উচিত।
দুর্যোধনের কথা শুনে রাজারা যুদ্ধ সম্পর্কে নানাপ্রকার মন্তব্য করলেন। অশ্বত্থামা বললেন, পণ্ডিতগণের মতে কার্যসিদ্ধির উপায় এই চারটি - কাজে আগ্রহ, উদ্যোগ, দক্ষতা ও নীতি; কিন্তু সবই দৈবের অধীন। আমাদের পক্ষে যেসকল আগ্রহী উদ্যোগী দক্ষ ও নীতিজ্ঞ মহারথ ছিলেন তাঁরা হত হয়েছেন। তথাপি আমাদের হতাশ হওয়া উচিত নয়, কারণ উপযুক্ত নীতির প্রয়োগে দৈবকেও অনুকূল করা যায়। আমরা কর্ণকে সেনাপতি করে শত্রুকুল বিনষ্ট করবো। ইনি মহাবল, অস্ত্রবিশারদ, যুদ্ধে দুর্ধর্ষ এবং যমের মতো ভয়ঙ্কর। ইনিই যুদ্ধে শত্রুজয় করবেন।
দুর্যোধন আশ্বস্ত ও প্রীত হয়ে কর্ণকে বললেন, মহাবাহু, আমি তোমার বীরত্ব এবং আমার প্রতি তোমার প্রীতি জানি। ভীষ্ম আর দ্রোণ মহাধনুর্ধর হলেও বৃদ্ধ এবং অর্জুনের পক্ষপাতী ছিলেন, তোমার কথাতেই আমি তাদের সেনাপতির পদ দিয়েছিলাম। তারা নিহত হয়েছেন, এখন তোমার মতো অন্য যোদ্ধা আমি দেখছি না। তুমি জয়ী হবে তাতে আমার সন্দেহ নেই, অতএব তুমি আমার সৈন্য পরিচালনার ভার নাও, নিজেই নিজেকে সেনাপতিত্বে অভিষিক্ত করো। তুমি সামনে থাকলে অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইবে না। কর্ণ বললেন, আমি সপুত্র পাণ্ডবগণ ও কৃষ্ণকে জয় করবো। তুমি নিশ্চিন্ত হও, আমি তোমার সেনাপতি হবো। ধরে নাও যে পাণ্ডবরা পরাজিত হয়েছে।
তারপর দুর্যোধন ও অন্যান্য রাজারা মহার্ঘ বস্ত্র পরিহিত তাম্রময় আসনে কর্ণকে বসালেন এবং জলপূর্ণ স্বর্ণময় ও মৃন্ময় কলস এবং মণিমুক্তাভূষিত গজদন্ত, গণ্ডারশৃঙ্গ ও ষাঁড়ের শৃঙ্গে নির্মিত পাত্র দ্বারা শাস্ত্রবিধি অনুসারে কর্ণকে অভিষিক্ত করলেন। বন্দনাকারী ও ব্রাহ্মণগণ বললেন, কর্ণ, সূর্য যেমন অন্ধকার নষ্ট করেন, আপনি তেমন পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে ধ্বংস করুন। পেচক যেমন সূর্যের প্রখর রশ্মি সইতে পারে না, কৃষ্ণ ও পাণ্ডবরাও সেইরূপ আপনার বাণবর্ষণ সইতে পারবেন না। ইন্দ্রের সামনে দানবদের মতো পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণও আপনার সামনে দাঁড়াতে পারবেন না।
______________
(ক্রমশ)