মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৪৩
ষোড়শ দিনের যুদ্ধে অশ্বত্থামার পরাজয়
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
ষোড়শ দিনের যুদ্ধে অশ্বত্থামার পরাজয়
কর্ণকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করার পরদিন সূর্যোদয় হোলে কর্ণ যুদ্ধসজ্জার আদেশ দিলেন। তখন হাতি, ঘোড়া, ও রথ সকল প্রস্তুত কোরে যোদ্ধারা পরস্পরকে ডাকতে লাগলেন। কর্ণ শঙ্খধ্বনি করতে করতে যুদ্ধযাত্রা করলেন। তার রথ শ্বেতপতাকায় ভূষিত এবং বহু ধনু, তুণীর, গদা, শতঘ্নী, শক্তি, শূল, তোমর প্রভৃতি অস্ত্র সম্বলিত। সাদা রঙ-এর চার ঘোড়া সেই রথ বহন করে নিয়ে চলল। কর্ণ মকরব্যূহ সাজিয়ে নিজে তার মুখে রইলেন এবং শকুনি, উলূক, অশ্বত্থামা, দুর্যোধনাদি, নারায়ণী সেনা সহ কৃতবর্মা, ত্রিগর্ত ও দাক্ষিণাত্য সৈন্য সহ কৃপাচার্য, মদ্রদেশীয় সৈন্য সহ শল্য, এক হাজার রথ ও তিন শত হাতি সহ সুষেণ এবং বিশাল বাহিনী সহ রাজা চিত্র ও তার ভাই চিত্রসেন সেই ব্যূহের বিভিন্ন অংশ রক্ষা করতে লাগলেন।
কর্ণকে সসৈন্যে আসতে দেখে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, কৌরববাহিনীর শ্রেষ্ঠ বীরগণ নিহত হয়েছেন, কেবল নিকৃষ্ট যোদ্ধারা অবশিষ্ট আছেন। কর্ণই ওদের পক্ষের একমাত্র মহাধনুর্ধর, তাকে বধ করে তুমি বিজয়ী হও। যে কাঁটা তেরো বছর আমার হৃদয়ে বিঁধে আছে তা কর্ণ নিহত হোলে নিরাময় হবে, এই ভেবে তুমি ইচ্ছামত সৈন্যদের ব্যূহ সাজাও। তখন অর্জুন অর্ধচন্দ্ৰব্যূহ সাজালেন, তার বাম পাশে ভীম, ডান পাশে ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং মাঝখানে যুধিষ্ঠির, পিছনে নকুল সহদেব রইলেন। দুই পাঞ্চালবীর যুধামন্যু ও উত্তমৌজা এবং অন্যান্য যোদ্ধারা ব্যূহের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করলেন।
যুদ্ধ আরম্ভ হোলে হাতির পিঠে ভীম ও কুনূত দেশের রাজা ক্ষেমধূর্তি সসৈন্যে পরস্পরকে আক্রমণ করলে ক্ষেমধূর্তি ভীমের গদাঘাতে নিহত হলেন। কর্ণের সঙ্গে নকুল, অশ্বত্থামার সঙ্গে ভীম, কেকয়দেশীয় বিন্দ অনুবিন্দের সঙ্গে সাত্যকি, অর্জুনপুত্র শ্রুতকর্মার সঙ্গে রাজা চিত্রসেন, যুধিষ্ঠিরপুত্র প্রতিবিন্ধ্যের সঙ্গে চিত্র, দুর্যোধনের সঙ্গে যুধিষ্ঠির, সংশপ্তকগণের সঙ্গে অর্জুন, কৃপাচার্যের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্ন, কৃতবর্মার সঙ্গে শিখণ্ডী, শল্যের সঙ্গে সহদেবপুত্র শ্রুতসেন এবং দুঃশাসনের সঙ্গে সহদেব ঘোর যুদ্ধ করতে লাগলেন।
সাত্যকির বাণের আঘাতে অনুবিন্দ এবং তরবারির আঘাতে বিন্দ নিহত হলেন। শ্রুতকর্মা ভল্লের আঘাতে চিত্রসেনের মাথা কেটে ফেললেন। প্রতিবিন্ধ্যের তোমরের আঘাতে চিত্র নিহত হলেন। ভীমের প্রচণ্ড শক্তি এবং অশ্বত্থামার আশ্চর্য অস্ত্রশিক্ষা দেখে আকাশচারী সিদ্ধ মহর্ষি ও দেবগণ সাধু সাধু বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর অশ্বত্থামা ও ভীম পরস্পরের বাণের আঘাতে অচেতন হয়ে নিজ নিজ রথের মধ্যে পড়ে গেলে তাদের সারথিরা রথ সরিয়ে নিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে অশ্বত্থামা আবার রণভূমিতে এসে অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। অর্জুন তখন সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। কৃষ্ণ অশ্বত্থামার কাছে রথ নিয়ে গিয়ে বললেন, অশ্বত্থামা, আপনি স্থির হয়ে অস্ত্রপ্রহার করুন এবং অর্জুনের প্রহার সহ্য করুন। ব্রাহ্মণদের বাদানুবাদ সূক্ষ্ম, কিন্তু ক্ষত্রিয়ের জয়পরাজয় স্থূল অস্ত্রে নির্ধারিত হয়। আপনি মোহের বশে অর্জুনের কাছে যা চেয়েছেন তা পাবার জন্য স্থির হয়ে যুদ্ধ করুন। “তাই হবে” - এই বলে অশ্বত্থামা অনেকগুলি নারাচ নিক্ষেপ কোরে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বিদ্ধ করলেন। অর্জুনও তাঁর গাণ্ডীব ধনু থেকে নিরন্তর বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। কলিঙ্গ,বঙ্গ, অঙ্গ ও নিষাদ বীরগণ ঐরাবততুল্য হাতির দল নিয়ে অর্জুনের প্রতি ধাবিত হলেন, কিন্তু অর্জুনের বাণ বর্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে পলায়ন করলেন।
অশ্বত্থামার তীক্ষ্ণ বাণের আঘাতে কৃষ্ণ ও অর্জুন রক্তাক্ত হলে লোকে মনে করলো তারা নিহত হয়েছেন। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তুমি অসাবধান হয়ে আছ কেন, অশ্বত্থামাকে বধ করো। প্রতিকার না করলে ব্যাধি যেমন কষ্টকর হয়, অশ্বত্থামাকে উপেক্ষা করা সেইরূপ বিপজ্জনক হবে। তখন অর্জুন সাবধানে শরক্ষেপণ করে অশ্বত্থামার দুই বাহু, বুক, মাথা ও ঊরুদ্বয় বিদ্ধ করলেন। অশ্বত্থামার রথের ঘোড়াগুলি আহত হয়ে রথ নিয়ে সবেগে দূরে চলে গেল। অর্জুনের বাণের আঘাতে আহত ও নিরুৎসাহ হয়ে অশ্বত্থামা আর যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করলেন না, কৃষ্ণ ও অর্জুনের জয় হয়েছে জেনে কর্ণের সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করলেন।
______________
(ক্রমশ)