Read Story of Mahabharat Part 146 Story of Parashuram and Killing of Tripur Asur by Ashoke Ghosh in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 146

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৪৬

ত্রিপুর অসুর সংহার ও পরশুরামের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ত্রিপুর অসুর সংহার ও পরশুরামের কাহিনি

দুর্যোধন শল্যকে বললেন, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় আমার পিতাকে দেবতা ও অসুরের মধ্যে যুদ্ধের যে ইতিহাস বলেছিলেন তা শুনুন। দৈত্যগণ দেবগণের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হলে তারকাসুরের তিন পুত্র তারাক্ষ, কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালী কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলো। ব্রহ্মা বর দিতে এলে তিন ভাই এই বর চাইল যে তারা যেন সকলের অবধ্য হয়। ব্রহ্মা বললেন, সকলেই অমরত্ব পেতে পারে না, তোমরা অন্য বর চাও। তখন তারকের পুত্রেরা বহু মন্ত্রণা করে বললো, আমরা তিনটি চলমান নগরে বাস করতে ইচ্ছা করি যেখানে সর্বপ্রকার অভীষ্ট বস্তু থাকবে, দেব দানব যক্ষ রাক্ষস প্রভৃতি যা বিনষ্ট করতে পারবে না এবং কোনো তন্ত্র-মন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র বা ব্রহ্মশাপেও যার হানি হবে না। আমরা এই তিন পুরে বাস কোরে জগতে বিচরণ করবো। হাজার বছর পরে আমরা তিন জনে মিলিত হবো, তখন আমাদের তিনটি নগর বা ত্রিপুর এক হয়ে যাবে। সেই সময়ে যে দেবশ্রেষ্ঠ সম্মিলিত ত্রিপুরকে এক বাণে ভেদ করতে পারবেন তিনিই আমাদের মৃত্যুর কারণ হবেন। ব্রহ্মা তাই হবে বলে প্রস্থান করলেন।

তারকের পুত্রগণ ময় দানবকে ত্রিপুর নির্মাণের ভার দিলো। ময় দানব তপস্যার প্রভাবে একটি সোনার, একটি রূপার এবং একটি লোহার নগর বা পুর নির্মাণ করলেন। প্রথম পুরটি স্বর্গে, দ্বিতীয়টি অন্তরীক্ষে এবং তৃতীয়টি পৃথিবীতে থাকত। এই তিনটি পুরের প্রত্যেকটি চাকা যুক্ত করা, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে শত যোজন এবং বিশাল প্রাকার, তোরণ, প্রাসাদ, রাজপথ প্রভৃতি সমন্বিত। তারকাক্ষ সোনার পুরে, কমলাক্ষ রূপার পুরে এবং বিদ্যুন্মালী লোহার পুরে বাস করতে লাগল। দেবগণ কর্তৃক বিতাড়িত কোটি কোটি দৈত্য এসে সেই ত্রিপুরে আশ্রয় নিলে ময় দানব তাদের মনের সমস্ত বাসনা পূরণ করলেন। তারকাক্ষের হরি নামে এক পুত্র ছিল, সে ব্রহ্মার নিকট বর পেয়ে প্রত্যেক পুরে মৃতসঞ্জীবনী পুকুর নির্মাণ করলো। মৃত দৈত্যগণকে সেই পুকুরে নিক্ষেপ করলে সে জীবিত হয়ে উঠত।

তারপর সেই তিন দৈত্য ইচ্ছামতো বিচরণ কোরে দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ এবং ত্রিলোকের সকলের উপর উৎপীড়ন করতে লাগল। ইন্দ্র ত্রিপুরের সকল দিকে বজ্রাঘাত কোরেও কিছুই করতে পারলেন না। তখন দেবগণ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা বললেন, এই ত্রিপুর কেবল একটি বাণে ভেদ করা যায়, কিন্তু মহাদেব ছাড় আর কেউ তা পারবেন না, অতএব তোমরা তাকে যোদ্ধা রূপে বরণ করো। দেবতারা তখন মহাদেবের কাছে গিয়ে তাকে তুষ্ট করলে মহাদেব অভয় দেওয়ায় ব্রহ্মা তার প্রদত্ত বরের কথা জানিয়ে বললেন, আপনি শরণাপন্ন দেবগণের উপর প্রসন্ন হয়ে দানবগণকে বধ করুন। মহাদেব বললেন, দানবরা প্রবল, আমি একাকী তাদের বধ করতে পারব না। তোমরা সকলে মিলিত হয়ে আমার অর্ধেক তেজ নিয়ে তাদের জয় করো। দেবগণ বললেন, আমাদের যত শক্তি দানবদের তার দ্বিগুণ। মহাদেব বললেন, সেই পাপীরা তোমাদের কাছে অপরাধী সেজন্য তারা বধ্য। তোমরা আমার শক্তির অর্ধেক নিয়ে শত্রুদের বধ করো। দেবগণ বললেন, আমরা আপনার অর্ধেক শক্তি ধারণ করতে পারব না, অতএব আপনিই আমাদের সকলের অর্ধেক শক্তি নিয়ে শত্রুবধ করুন।

মহাদেব রাজি হয়ে দেবগণের অর্ধেক শক্তি নিলেন। তার ফলে তার শক্তি সকলের চেয়ে অধিক হোলো। তারপর দেবতাদের নির্দেশ অনুসারে বিশ্বকর্মা মহাদেবের রথ নির্মাণ করলেন। পৃথিবী দেবী, মন্দর পর্বত, নক্ষত্র ও গ্রহগণ, নাগরাজ বাসুকি, হিমালয় পর্বত, বিন্ধ্য গিরি, সপ্তর্ষিমণ্ডল, গঙ্গা, সরস্বতী ও সিন্ধু নদী, শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষ, রাত্রি ও দিন প্রভৃতি দিয়ে রথের বিভিন্ন অংশ নির্মিত হোলো। চন্দ্র ও সূর্য রথের চাকা হলেন এবং ইন্দ্র, বরুণ, যম ও কুবের এই চার লোকপাল ঘোড়া হলেন। সুমেরু পর্বত রথের ধ্বজদণ্ড এবং বিদ্যুৎবাহী মেঘ পতাকা হোলো। মহাদেব বছরকে ধনু এবং কালরাত্রিকে জ্যা করলেন। বিষ্ণু ও অগ্নি  মহাদেবের বাণ হলেন।

খড়্গ, বাণ ও ধনু হাতে নিয়ে মহাদেব দেবগণকে বললেন, সারথি কে হবেন? আমার চেয়ে যিনি শ্রেষ্ঠতর তাকেই তোমরা সারথি করো। তখন দেবতারা ব্রহ্মাকে বললেন, আপনি ভিন্ন আমরা সারথি দেখছি না, আপনি দেবগণের শ্রেষ্ঠ, অতএব আপনিই মহাদেবের রথ চালনা করুন। ব্রহ্মা রাজি হয়ে রথে উঠে মহাদেবকে বললেন রথে আরোহণ করুন। তার পর মহাদেব রথে উঠে ব্রহ্মাকে বললেন, যেখানে দৈত্যরা আছে সেদিকে সাবধানে রথ নিয়ে চলুন।

ব্রহ্মা ত্রিপুরের দিকে রথ নিয়ে চললেন। সেই সময়ে বাণরূপী বিষ্ণু ও অগ্নি এবং রথে উপবিষ্ট ব্রহ্মা ও মহাদেবের ভারে রথ ভূমিতে বসে গেল। তখন নারায়ণ বাণ থেকে বেরিয়ে এসে ষাঁড়ের রূপ ধারণ কোরে সেই মহারথ ভূমি থেকে তুললেন। তখন মহাদেব বৃষরূপী নারায়ণের পিঠে এক পা এবং ঘোড়ার পিঠে অন্য পা রেখে দানবপুর দেখলেন। তারপর মহাদেব তার ধনুতে পাশুপত অস্ত্র যোগ কোরে অপেক্ষা করছিলেন এমন সময়ে দানবদের তিন পুর একত্র মিলিত হোলো। দেবগণ, সিদ্ধগণ ও মহর্ষিগণ জয়ধ্বনি করে উঠলেন, মহাদেব তাঁর দিব্য ধনু আকর্ষণ কোরে ত্রিপুর লক্ষ্য করে বাণ নিক্ষেপ করলেন। তুমুল আর্তনাদ কোরে ত্রিপুর আকাশ থেকে পড়তে লাগল এবং দানবগণের সহিত পুড়ে গিয়ে পশ্চিম সমুদ্রে গিয়ে পড়লো।

কাহিনি শেষ করে দুর্যোধন শল্যকে বললেন, পিতামহ ব্রহ্মা যেমন মহাদেবের সারথি হয়েছিলেন তেমন আপনিও কর্ণের সারথি হোন। কর্ণ মহাদেবের তুল্য এবং আপনি ব্রহ্মার সমান। আপনার উপরেই কর্ণ ও আমরা নির্ভর করছি, আমাদের রাজ্য ও বিজয়লাভও আপনার অধীন। আর একটি ঘটনা বলছি শুনুন, যা একজন ধর্মজ্ঞ ব্রাহ্মণ আমার পিতাকে বলেছিলেন। –

ভৃগুর বংশে জমদগ্নি নামে এক মহাতপা ঋষি জন্মেছিলেন, তার একটি তেজস্বী গুণবান পুত্র ছিল যিনি পরশুরাম নামে বিখ্যাত। এই পুত্রের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব বললেন, পরশুরাম, তুমি কি চাও তা আমি জানি। অপাত্র ও অক্ষমকে আমার অস্ত্রসকল বিনষ্ট করে। তুমি যখন পবিত্র হবে তখন তোমাকে অস্ত্রদান করবো। তারপর পরশুরাম বহু বছর তপস্যা, ইন্দ্রিয়দমন, নিয়ম পালন, পূজা, হোম প্রভৃতির দ্বারা মহাদেবের আরাধনা করলেন। মহাদেব বললেন, তুমি জগতের হিত এবং আমার প্রীতির নিমিত্ত দেবগণের শত্রুদের বধ করো। পরশুরাম বললেন, আমার কি শক্তি আছে? আমি অস্ত্রশিক্ষাহীন আর দানবগণ সকল অস্ত্রে স্ত্রবিশারদ ও দুর্ধর্ষ। মহাদেব বললেন, তুমি আমার নির্দেশে যাও, সকল শত্রু জয় কোরে তুমি সর্বগুণান্বিত হবে। পরশুরাম দৈত্যগণকে যুদ্ধে আহ্বান করে বজ্রতুল্য অস্ত্রের আঘাতে তাদের বধ করলেন। যুদ্ধকালে পরশুরামের দেহে যে ক্ষত হয়েছিল মহাদেবের হাতের স্পর্শে তা দূর হোলো। মহাদেব খুশি হয়ে বললেন, দানবদের অস্ত্রাঘাতে তোমার শরীরে যে ক্ষত হয়েছিল তাতে তোমার মানব কর্ম শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমার কাছ থেকে অভীষ্ট দিব্য অস্ত্রসমূহ নাও।

তারপর মহাতপা পরশুরাম দিব্যাস্ত্র ও বর লাভ কোরে মহাদেবের অনুমতি নিয়ে ফিরে গেলেন। মহারাজ শল্য, পরশুরাম প্রীত হয়ে মহাত্মা কর্ণকে সেই সমস্ত ধনুর্বিদ্যা দান করেছিলেন। কর্ণের যদি পাপ থাকত তবে পরশুরাম তাঁকে দিব্যাস্ত্র দিতেন না। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না যে কর্ণ সূতকুলে জন্মেছেন। আমি মনে করি তিনি ক্ষত্রিয়কুলে জাত দেবপুত্র, পরিচয় গোপনের জন্য পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। সূতনারী কি করে কবচকুণ্ডলধারী দীর্ঘবাহু সূর্যতুল্য মহারথের মা হতে পারে? হরিণ কি বাঘ প্রসব করে?

______________

(ক্রমশ)