Read Story of Mahabharat Part 148 Quarrel between Karna and Shalya by Ashoke Ghosh in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 148

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৪৮

কর্ণ ও শল্যের বিবাদ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কর্ণ ও শল্যের বিবাদ

কর্ণ যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন দেখে কৌরবগণ খুশি হলেন। সেই সময়ে ভূমিকম্প, উল্কাপাত, বিনা মেঘে বজ্রপাত, কর্ণের রথের ঘোড়ার পড়ে যাওয়া, আকাশ থেকে রক্তবর্ষণ প্রভৃতি নানা দুর্লক্ষণ দেখা গেল, কিন্তু মোহগ্রস্ত কৌরবগণ সে সকল গ্রাহ্য করলেন না, কর্ণের উদ্দেশ্যে জয়ধ্বনি করতে লাগলেন।

অভিমানে অহংকারে ও ক্রোধে জ্বলে উঠে কর্ণ শল্যকে বললেন, আমি যখন ধনু হাতে নিয়ে রথে থাকি তখন ক্রুদ্ধ ইন্দ্রকেও ভয় করি না, ভীষ্ম আদি বীরগণের পতন দেখেও আমার সাহস নষ্ট হয় না। আমি জানি যে সবকিছু অনিত্য, সেজন্য ইহলোকে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আচার্য দ্রোণের নিধনের পর কে নিঃসংশয়ে বলতে পারে যে কাল সূর্যোদয়ের সময় সে বেঁচে থাকবে? মদ্ররাজ, আপনি দ্রুত পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণের দিকে রথ নিয়ে চলুন, আমি তাদের যুদ্ধে বধ করবো অথবা দ্রোণের ন্যায় যমলোকে যাবো। পরশুরাম আমাকে এই বাঘের চামড়ায় ঢাকা উত্তম রথ দিয়েছেন। চলার সময় এর চাকায় শব্দ হয় না, এতে তিনটি সোনার কোষ এবং তিনটি রূপার দণ্ড আছে, চারটি উত্তম ঘোড়া এর বাহন। বিচিত্র ধনু, পতাকা, গদা, ভয়ংকর বাণ, তীক্ষ্ণ তরবারি ও অন্যান্য অস্ত্র এবং ঘোর শব্দকারী শুভ্র শঙ্খও তিনি আমাকে দিয়েছেন। এই রথে চড়ে আজ আমি অর্জুনকে বধ করবো কিংবা মৃত্যু যদি তাকে ছেড়ে দেন তবে আমিও ভীষ্মের মতো যমলোকে যাবো।

শল্য কর্ণকে বললেন, থাম থাম, আর আত্মপ্রশংসা কোরো না, তুমি অতিরিক্ত ও অযোগ্য কথা বলছ। কোথায় পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন, আর কোথায় পুরুষাধম তুমি! অর্জুন ভিন্ন আর কে ইন্দ্রপুরীর মতো দ্বারকা থেকে কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে হরণ করতে পারেন? কোন পুরুষ কিরাতবেশী মহাদেবকে যুদ্ধে আহ্বান করতে পারেন? তোমার মনে পড়ে কি, ঘোষযাত্রার সময় যখন গন্ধর্বরা দুর্যোধনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন অর্জুনই তাকে উদ্ধার করেছিলেন? সেই যুদ্ধে প্রথমে তুমিই পালিয়েছিলে এবং পাণ্ডবগণই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তোমরা যখন সসৈন্যে ভীষ্ম, দ্রোণ ও অশ্বত্থামার সঙ্গে বিরাটের গরু চুরি করতে গিয়েছিলে তখন অর্জুনই তোমাদের জয় করেছিলেন, তুমি তাকে জয় করতে পারনি কেন? ঘোর যুদ্ধ আসন্ন হয়েছে, যদি পালিয়ে না যাও তবে আজ তুমি মরবে।

কর্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শল্যকে বললেন, অনেক হয়েছে, অর্জুনের এত প্রশংসা করছেন কেন? সে যদি যুদ্ধে আজ আমাকে জয় করতে পারে তবেই আপনার প্রশংসা সার্থক হবে। তাই হবে বলে শল্য আর উত্তর দিলেন না, কর্ণের ইচ্ছ অনুসারে রথচালনা করলেন। পাণ্ডবসৈন্যের নিকটে এসে কর্ণ বললেন, অর্জুন কোথায়? অর্জুনকে যে দেখিয়ে দেবে আমি তার সমস্ত বাসনা পূরণ করবো।

কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন ও তার অনুচরগণ খুশি হলেন। শল্য হেসে বললেন, তোমাকে কারো বাসনা পূরণ করতে হবে না, তুমি পুরস্কার না দিয়েই অর্জুনকে দেখতে পাবে। পূর্বে মূর্খের মতো বিস্তর ধন তুমি অপাত্রে দান করেছ, তাতে বহু যজ্ঞ করতে পারত। তুমি বৃথা অর্জুনকে বধ করতে চাইছ, একটা শৃগাল সিংহকে বধ করেছে এ আমি শুনিনি। গলায় পাথর বেঁধে সমুদ্রে সাঁতার অথবা পর্বতের উপর থেকে লাফ দেওয়ার ইচ্ছা যেমন, তোমার ইচ্ছাও তেমন। যদি মঙ্গল চাও তবে সমস্ত যোদ্ধা এবং ব্যূহবদ্ধ সৈন্যে সুরক্ষিত হয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যেয়ো। যদি বাঁচতে চাও তবে আমার কথায় বিশ্বাস করো।

কর্ণ বললেন, আমি নিজের বাহুবলে নির্ভর করে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই। আপনি বন্ধুর বেশে শত্রু তাই আমাকে ভয় দেখাতে চান। শল্য বললেন, অর্জুনের নিক্ষিপ্ত তীক্ষ বাণ যখন তোমাকে আঘাত করবে তখন তোমার অনুতাপ হবে। মায়ের কোলে শুয়ে বালক যেমন চাঁদকে ছুঁতে চায়, তুমিও তেমন মোহগ্রস্ত হয়ে অর্জুনকে জয় করতে চাইছ। তুমি ব্যাং হয়ে মেঘের তুল্য অর্জুনের উদ্দেশে গর্জন করছ। কুকুর যেমন বাঘকে লক্ষ্য করে ডাকে তুমি তেমন বাঘের তুল্য অর্জুনকে ডাকছ। মূর্খ, তুমি শৃগালের তুল্য আর অর্জুন সিংহের তুল্য।

কর্ণ শল্যকে বললেন, আপনি সর্বগুণহীন, অতএব গুণাগুণ বুঝবেন কি কোরে? কৃষ্ণের মহিমা আমি যেমন জানি আপনি তেমন জানেন না। আমি নিজের ও অর্জুনের শক্তি জেনেই তাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি। আমার এই বিষাক্ত ভয়ংকর বাণ বহু বৎসর ধরে তূণের মধ্যে পড়ে আছে, এই বাণ নিয়েই আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবো। পিসির পুত্র এবং মামার পুত্র এই দুই ভাই অর্জুন ও কৃষ্ণ এক সুতোয় গাঁথা দুই মণির তুল্য। আপনি দেখবেন দুজনেই আমার বাণে নিহত হবেন। আজ কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বধ কোরে আপনাকেও সবান্ধবে বধ করবো। দুর্বুদ্ধি ক্ষত্রিয়কুলাঙ্গার, আপনি শুভানুধ্যায়ীরা বেশে শত্রুর মতো আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। আপনি চুপ করে থাকুন, হাজার কৃষ্ণ বা শত অর্জুন এলেও আমি তাদের বধ করবো। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই যে গাথা বলে এবং পূর্বে ব্রাহ্মণগণ রাজার নিকট যা বলেছিলেন, দুরাত্মা মদ্রদেশবাসীদের সেই গাথা শুনুন।

-মদ্রকগণ কটুভাষী নরাধম মিথ্যাবাদী কুটিল এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত দুষ্ট স্বভাবের। তারা বাবা মা পুত্র শ্বশুর শাশুড়ী মামা জামাই কন্যা পৌত্র বন্ধু আত্মীয় দাস দাসী প্রভৃতি স্ত্রী ও পুরুষ মিলিত হয়ে ছাতু ও মাছ খায়, গোমাংসের সাথে মদ্যপান করে, অশ্রাব্য গান গায় এবং কামে প্রবৃত্ত হয়। মদ্রকের সঙ্গে শত্রুতা বা মিত্ৰতা করা অনুচিত, তারা সর্বদাই পাপী। রাজা স্বয়ং যাজক হলে যেমন যজ্ঞ নষ্ট হয়, শূদ্রের যাজক ব্রাহ্মণ এবং বেদবিদ্বেষী লোকে যেমন পতিত হয়, তেমনই মদ্রকের সংসর্গে লোকে পতিত হয়। আমি অথর্ব বেদে বর্ণিত মন্ত্র পাঠ কোরে বলছি তোমার কথার বিষ নষ্ট হোলো।

তারপর কর্ণ বললেন, মদ্রদেশের স্ত্রীলোকে মদ্যপান কোরে নগ্ন হয়ে নাচে, তারা অসংযত স্বেচ্ছাচারিণী। যারা উট ও গাধার মতো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে সেই ধর্মভ্রষ্ট নির্লজ্জ স্ত্রীলোকের পুত্র হয়ে আপনি ধর্মের কথা বলছেন। আমরা শুনেছি মদ্রদেশের নারীরা কম্বল পরে, তারা গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি, নির্লজ্জ, উদরপরায়ণ ও অশুচি। মদ্র, সিন্ধু ও সৌবীর এই তিনটি পাপদেশ, সেখানকার লোকেরা ম্লেচ্ছ ও ধর্মজ্ঞানহীন। নিশ্চয় পাণ্ডবরা আমাদের মধ্যে বিভেদ ঘটাবার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছে। আপনি দুর্যোধনের মিত্র, আপনাকে হত্যা করলে নিন্দা হবে এবং আমাদের ক্ষমাগুণও আছে, এই তিন কারণে আপনি এখনও জীবিত আছেন। যদি আবার এরূপ কথা বলেন তবে এই গদার আঘাতে আপনার মাথা চূর্ণ করবো।

______________

(ক্রমশ)