Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 18

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৮

ভীম কর্তৃক বকরাক্ষস বধ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ভীম কর্তৃক বকরাক্ষস বধ

বেদব্যাস ছদ্মবেশী পাণ্ডবগণকে একচক্রা নগরে তাঁর পরিচিত ব্রাহ্মণের গৃহে রেখে চলে যাওয়ার পর পাণ্ডবগণ একচক্রা নগরে সেই ব্রাহ্মণের গৃহে বাস করতে লাগলেন। তারা তপস্বীর বেশে প্রতিদিন ভিক্ষা করে যা আনতেন, কুন্তী সেই সমস্ত খাদ্য দুই ভাগ করতেন, এক ভাগ ভীম একাই খেতেন, অন্য ভাগ অপর চার ভাই ও কুন্তী খেতেন।

এইভাবে বেশ কিছুদিন তারা সেই ব্রাহ্মণের গৃহে থাকাকালিন একদিন যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল ও সহদেব ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন আর ভীম ও কুন্তী গৃহে আছেন। এমন সময় ভীম ও কুন্তী তাদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহের ভিতর থেকে আর্তনাদ শুনতে পেযে, কুন্তী গৃহের ভিতর গিয়ে দেখলেন, ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার সঙ্গে বিষগ্নমুখে বিলাপ করছেন। ব্রাহ্মণ বলছিলেন, ব্রাহ্মণী, আমি নিরাপদ স্থানে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি দুর্বুদ্ধিবশত এই গৃহ ছেড়ে যেতে চাওনি, তার ফলে এখন আমাদের বিনাশ হবে। যে আমার নিত্যসঙ্গিনী পতিব্রতা ধর্মপত্নী তাকে আমি ত্যাগ করতে পারি না, আমার নাবালিকা কন্যা বা পুত্রকেও ছাড়তে পারি না। যদি আমি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিই তবে তোমরাও বাঁচবে না। হায় ঈশ্বর, আমাদের কি হবে, এর চেয়ে সকলের এক সঙ্গে মরাই ভালো।

ব্রাহ্মণী বললেন, তুমি এত কষ্ট পাচ্ছো কেনো? লোকে নিজের জন্যই পত্নী ও পুত্রকন্যা চায়। তুমি গৃহে থেকে পুত্রকন্যার লালন-পালন করো, আমিই যাবো, তাতে আমার অক্ষয় পুণ্য হবে। লোকে স্ত্রীর কাছে যা চায় সেই পুত্রকন্যা তুমি পেয়েছো, তোমার অভাবে আমি তাদের ভরণপোষণ করতে পারব না। এই কন্যার বিবাহ এবং পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা আমি কি কোরে করবো? আমার অভাবে তুমি অন্য স্ত্রী পাবে, কিন্তু আমার পক্ষে অন্য পতি গ্রহণ করা ঘোর অধর্ম। অতএব আমাকে যেতে দাও।

এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীকে আলিঙ্গন করে কাঁদতে লাগলেন। তখন তাদের কন্যা বলল, একদিন আমাকে তো তোমাদেরকে ছেড়ে যেতে হবে, বরং এখনই আমাকে যেতে দাও, তাতে তোমরা সকলে নিস্তার পাবে, আমিও স্বর্গলাভ করবো। নিতান্তই বালক পুত্রটি কলকণ্ঠে বললো, তোমরা কেঁদো না, আমি গিয়ে সেই রাক্ষসকে মেরে ফেলবো।

কুন্তী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের দুঃখের কারণ কি বলুন, যদি পারি তো দূর করতে চেষ্টা করবো। ব্রাহ্মণ বললেন, এই নগরের নিকট বক নামে এক ভয়ঙ্কর রাক্ষস বাস করে। আমাদের রাজা তার রাজপ্রাসাদে থাকেন। আমাদের রাজা নির্বোধ ও দুর্বল, প্রজাদের রক্ষার উপায় জানেন না। একদিন বক রাক্ষস এই দেশে এসে প্রজাদের ধরে ধরে খেতে লাগলো এবং নানা রকম অত্যাচার করতে লাগলো। রাজা কোনোভাবে প্রজাদেরকে রক্ষা করতে না পেরে, বক রাক্ষসের সঙ্গে সন্ধি করে। সেই সন্ধির শর্ত অনুযায়ী প্রতিদিন একজন লোককে প্রচুর অন্ন ও দুই মহিষ সঙ্গে নিয়ে বক রাক্ষসের কাছে পাঠাতে হয়। বক সেই মানুষ মহিষ আর অন্ন ভোজন করে। আজ আমার পালা, আমার এমন ধন নেই যে অন্য কোনও মানুষকে কিনে নিয়ে রাক্ষসের কাছে পাঠাই। তাই আমি স্ত্রী পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে তার কাছে যাবো যাতে সে আমাদের সকলকেই সে খেয়ে ফেলে।

কুন্তী বললেন, আপনি দুঃখ করবেন না, আমার পাঁচ পুত্রের একজন রাক্ষসের কাছে যাবে। ব্রাহ্মণ বললেন, আপনারা আমার শরণাগত ব্রাহ্মণ অতিথি, আমাদের জন্য আপনার পুত্রের প্রাণনাশ হোতে পারে না। কুন্তী বললেন, আমার পুত্র বলবান, মন্ত্রসিদ্ধ ও তেজস্বী। সে রাক্ষসের খাদ্য পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু, আপনি কারও কাছে প্রকাশ করবেন না, কারণ, লোকে মন্ত্রশিক্ষার জন্য আমার পুত্রের উপর উপদ্রব করবে। কুন্তীর কথা শুনে ব্রাহ্মণ অতিশয় আনন্দিত হোলেন। এমন সময় যুধিষ্ঠিরাদি ভিক্ষা নিয়ে ফিরে এলেন। ভীম রাক্ষসের কাছে যাবেন শুনে, যুধিষ্ঠির মাকে বললেন, যাঁর ভরসায় আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি, যার ভয়ে দুর্যোধন প্রভৃতি বিনিদ্র থাকে, যে জতুগৃহ থেকে আমাদের উদ্ধার করেছে, সেই ভীমকে আপনি কোন বুদ্ধিতে রাক্ষসের  কাছে পাঠাচ্ছেন ? কুন্তী বললেন, যুধিষ্ঠির, ভীমের বল অযুত হস্তীর সমান, তার তুল্য বলবান কেউ নেই। এই ব্রাহ্মণের গৃহে আমরা সুখে নিরাপদে বাস করছি, এঁর উপকার করা আমাদের কর্তব্য।

পরের দিন ভীম অন্ন নিয়ে বক রাক্ষস যেখানে থাকে সেই বনে গেলেন এবং তার নাম ধরে জোরে ডাকতে লাগলেন। সেই ডাক শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হোয়ে বক রাক্ষস দ্রুতবেগে ভীমের কাছে এসে দেখলো, ভীম তার জন্য নিয়ে আসা অন্ন ভোজন করছে। বক বললো, আমার অন্ন আমার সামনেই খাচ্ছ, তোমার মরবার ইচ্ছা হয়েছে? ভীম মুখ ফিরিয়ে হাসতে হাসতে খেতে লাগলেন। রাক্ষস দুই হাত দিয়ে ভীমের পিঠে আঘাত করলো, কিন্তু ভীম গ্রাহ্য করলেন না। রাক্ষস একটা গাছ উপড়ে নিয়ে ভীমকে আক্রমণ করতে এল। ভীম ভোজন শেষ করে বাঁ হাতে রাক্ষসের নিক্ষিপ্ত গাছ ধরে ফেললেন। তখন দুজনে মল্লযুদ্ধ হোতে লাগলো। একটু পরেই ভীম বক রাক্ষসকে মাটিতে ফেলে পদপিষ্ট করে মেরে ফেললেন। রাক্ষসের চিৎকার শুনে তার পরিবারের লোকজন ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভীম তাদের বললেন, তোমরা আর কখনও মানুষের প্রতি হিংসা করবে না, যদি করো তবে তোমাদেরও প্রাণ যাবে। রাক্ষসরা ভীমের আদেশ মেনে নিলে। তারপর ভীম রাক্ষসের মৃতহে নগরের প্রধান দ্বারে ফেলে দিয়ে অন্যের অজান্তে ব্রাহ্মণের গৃহে ফিরে এলেন। নগরবাসীরা আশ্চর্য হয়ে ব্রাহ্মণের কাছে সংবাদ নিতে গেলো। ব্রাহ্মণ বললেন, একজন মন্ত্রসিদ্ধ মহাত্মা আমাদের কান্নাকাটি শুনে দয়া কোরে আমার পরিবর্তে রাক্ষসের কাছে অন্ন নিয়ে গিয়েছিলেন, নিশ্চয় তিনিই তাকে বধ কোরে আমাদের সকলের উপকার করেছেন।

______________

(ক্রমশ)