Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 58

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৫৮

কাম্যক বনে পাণ্ডবদের কাছে কৃষ্ণ ও মার্কণ্ডেয়র আগমন

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কাম্যক বনে পাণ্ডবদের কাছে কৃষ্ণ ও মার্কণ্ডেয়র আগমন

পাণ্ডবগণ বিশাখকূপ বনে এক বছর শিকার কোরে এবং বর্ষা ও শরৎ ঋতু কাটিয়ে আবার কাম্যক বনে এসে বাস করতে লাগলেন। তাদের কাম্যক বনে ফিরে আসার সংবাদ পেয়ে একদিন সত্যভামাকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণ তাদের দেখতে এলেন। অর্জুনকে সুভদ্রা ও অভিমন্যুর কুশল সংবাদ দিয়ে কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বললেন, ভাগ্যক্রমে অর্জুন ফিরে এসেছেন, তোমার পরিবার এখন পূর্ণ হোলো। তোমার বালক পুত্রগণ মন দিয়ে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করছে ও সুশীল হয়েছে। সুভদ্রা সবর্দা তাদের সদাচার শিক্ষা দিচ্ছেন। প্রদ্যুম্ন ও অভিমন্যু তাদেরকে রথ ও ঘোড়া চালনা করা এবং বিবিধ অস্ত্রের প্রয়োগ শেখাচ্ছেন। তার পর কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, যাদবসেনা আপনার আদেশের অপেক্ষা করছে, আপনি পাপী দুর্যোধনকে সবান্ধবে বিনষ্ট করুন। অথবা আপনি পাশা খেলার সভায় যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাই পালন করুন, যাদবসেনাই আপনার শত্ৰু সংহার করবে, আপনি যথাকালে হস্তিনাপুর অধিকার করবেন। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমিই আমাদের পথ প্রদর্শক, উপযুক্ত কালে তুমি আমাদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করবে তাতে সংশয় নেই। আমরা প্রায় বারো বছর বনবাসে কাটিয়েছি, এরপর অজ্ঞাতবাস শেষ করেই তোমার শরণ নেব।

এমন সময়ে মহাতপা মার্কণ্ডেয় মুনি পাণ্ডবদের কাছে এলেন। তার বয়স বহু হাজার বছর কিন্তু তিনি দেখতে যুবকের মতো। তিনি আসন গ্রহণ করার পর কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, আমরা সকলে আপনার কাছে পুণ্যকথা শুনতে চাই। এই সময়ে দেবর্ষি নারদও পাণ্ডবদের দেখতে এলেন, তিনিও মার্কণ্ডেয়কে একই অনুরোধ করলেন।

কৃষ্ণ ও নারদের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় ধর্ম, অধর্ম, কর্মফল, ইহলোক, পরলোক প্রভৃতি সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে বললেন। পাণ্ডবগণ বললেন, আমরা ব্রাহ্মণ মাহাত্ম্য শুনতে ইচ্ছা করি, আপনি বলুন। মার্কণ্ডেয় তখন এই কাহিনি বললেন -

“হৈহয় বংশের এক রাজকুমার মৃগয়া করতে গিয়ে দূর থেকে কালো হরিণের চামড়া পরিহিত এক ব্রাহ্মণকে দেখে তাকে হরিণ ভেবে বাণ ছুঁড়ে হত্যা করার পরে ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে রাজপুরীতে ফিরে গিয়ে হৈহয় রাজাদেরকে তার পাপকর্মের কথা জানালেন। তখন হৈহয়রাজগণ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত মুনিকে দেখলেন এবং তার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে করতে মহর্ষি অরিষ্টনেমির আশ্রমে এলেন। মহর্ষি তাদের সংবর্ধনা দিতে গেলে তারা বললেন, আমরা ব্রহ্মহত্যা করেছি, সংবর্ধনা পাওয়ার যোগ্য নই। হৈহয় রাজাদের কথা শোনার পর সকলে ঘটনাস্থলে গেলেন কিন্তু মৃতদেহ দেখতে পেলেন না। তখন অরিষ্টনেমি বললেন, দেখুন তো, আমার এই পুত্ৰই সেই নিহত ব্রাহ্মণ কিনা। রাজারা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই মৃত মুনিকমার কি করে জীবিত হলেন? অরিষ্টনেমি বললেন, আমরা স্বধর্মের অনুষ্ঠান করি, ব্রাহ্মণদের যাতে মঙ্গল হয় তাই বলি, যাতে দোষ হয় এমন কথা বলি না। অতিথি ও পরিচারকদের ভোজনের পর যা অবশিষ্ট থাকে তাই আমরা খাই। আমরা শান্ত, জীতেন্দ্রিয়, ক্ষমাশীল, তীর্থ পর্যটক ও দানপরায়ণ। যে সকল কারণে আমাদের মৃত্যুভয় নেই তার কয়েকটি আপনাদেরকে বললাম। আপনারা এখন ফিরে যান, পাপের ভয় করবেন না। রাজারা হৃষ্ট হয়ে অরিষ্টনেমিকে প্রণাম করে চলে গেলেন।”

তারপর মার্কণ্ডেয় মহর্ষি অত্রির কাহিনি বললেন – “একদিন মহর্ষি অত্রি বনে গমনের ইচ্ছা করলে, তাঁর স্ত্রী বললেন, রাজর্ষি বৈণ্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করছেন, তুমি তার কাছে প্রার্থনা করে প্রচুর ধন নিয়ে এস এবং সেই ধন পুত্র ও পরিচারকদের ভাগ করে দিয়ে যেখানে ইচ্ছা হয় যেও। মহর্ষি অত্রি সম্মত হয়ে বৈণ্য রাজার কাছে গিয়ে তাঁর স্তুতি করে বললেন — রাজা, আপনি ধন্য, প্রজাগণের নিয়ন্তা ও পৃথিবীর প্রথম নরপতি। মুনিরা বলেন, আপনি ভিন্ন আর কেউ ধর্মজ্ঞ নেই। এই স্তুতি শুনে মহর্ষি গৌতম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, অত্রি, এমন কথা আর বলো না, ইন্দ্রই রাজাদের মধ্যে প্রথম। তুমি বোকা এবং অপরিণতবুদ্ধি, রাজাকে তুষ্ট করবার জন্য স্তুতি করছো। অত্রি ও গৌতম কলহ করছেন দেখে সভাস্থ ব্রাহ্মণগণ দুজনকে ধর্মজ্ঞ সনৎকুমারের কাছে নিয়ে গেলেন। সনৎকুমার বললেন, রাজাকে ধর্ম ও প্রজাপতি বলা হয়, তিনিই ইন্দ্র, ধাতা, প্রজাপতি, বিরাট, প্রভৃতি নামে পূজিত হন, সকলেই তার অর্চনা করে। অত্রি রাজাকে যে প্রথম বা প্রধান বলেছেন তা শাস্ত্রসম্মত। বিচারে অত্রিকে জয়ী দেখে বৈণ্য রাজা প্রীত হয়ে তাকে বহু ধন দান করলেন।”

______________

(ক্রমশ)