Featured Books
  • মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 95

    মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৫ দুর্যোধনের অসৎ অভিপ্রায়ের কাহিনি...

  • আয় কে ধরবি

    আয় কে ধরবি? পিচপিচে রোগা শীর্নকায় একটু বেঁটে কিন্তু সে ছিল...

  • আগুনের ছোঁয়া - পর্ব 3

    ভালোবাসা তখনই সত্যি, যখন তা ছুঁয়ে যায় তোমার সমস্ত দুর্বলতা...

  • নির্বাচন

    রুদ্রনীল ছোটবেলা থেকেই ‘ভাল ছেলে’ হিসেবে বড় হয়েছে। মা-বাবার...

  • ফুলবানু - 1

    বাসন্তী নদীর পাড়ে শিমুল নামের গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা পাক...

বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 95

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৫

দুর্যোধনের অসৎ অভিপ্রায়ের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

দুর্যোধনের অসৎ অভিপ্রায়ের কাহিনি

নারদ কথিত বিশ্বামিত্র, গালব, যযাতি ও মাধবীর কাহিনি শেষ হওয়ার পর ধৃতরাষ্ট্র বললেন, দেবর্ষি নারদের কথা সত্য, আমিও তাই চাই, কিন্তু আমার শক্তি নেই। কৃষ্ণ, তুমি যা বলেছ তা ধর্মসংগত ও ন্যায্য, কিন্তু বৎস, আমি স্বাধীন নই, দুরাত্মা পুত্ররা আমার আদেশ মানবে না, গান্ধারী, বিদুর, ভীষ্ম কারোর কথা দুর্যোধন শোনে না। তুমিই ওই দুরাত্মাকে বোঝাবার চেষ্টা করো।

কৃষ্ণ মিষ্টি কথায় দুর্যোধনকে বললেন, মহান বংশে তোমার জন্ম, তুমি শাস্ত্রজ্ঞ ও সর্বগুণান্বিত, সুতরাং যা ন্যায়সম্মত তাই করো। বংশের প্রবৃত্তি ধর্মার্থযুক্ত দেখা যায়, কিন্তু তোমার মধ্যে তার বিপরীতই দেখছি। ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিদুর, সোমদত্ত, বিকর্ণ, বিবিংশতি, সঞ্জয় এবং তোমার জ্ঞাতি ও মিত্রগণ সকলেই সন্ধি চান। তুমি পিতামাতার উপদেশ পালন করো। যে লোক শ্রেষ্ঠ শুভানুধ্যায়ীদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে কুচক্রী মন্ত্রণাদাতাদের মতে চলে সে ঘোর বিপদে পড়ে। তুমি আজন্ম পাণ্ডবদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার কোরে আসছ কিন্তু তারা তা সহ্য করেছেন। পাণ্ডবরা যে রাজ্য জয় করেছিলেন তা এখন তুমি ভোগ করছ, কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি প্রভৃতির সহায়তায় তুমি ঐশ্বর্যলাভ করতে চাচ্ছ। তোমার সমস্ত সৈন্য এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতি সকলে মিলেও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবেন না। খাণ্ডবপ্রস্থে যিনি দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ প্রভৃতিকে জয় করেছিলেন, কোন্ মানুষ তার সমকক্ষ? শুনেছি বিরাটনগরে বহুজনের সঙ্গে একজনের আশ্চর্য যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধই আমার উক্তির যথেষ্ট প্রমাণ। যিনি মহাদেবকে যুদ্ধে সন্তুষ্ট করেছিলেন, আমি যাঁর সঙ্গে থাকব, সেই অর্জুনকে তুমি জয় করবার আশা করো? রাজা দুর্যোধন, কৌরবকুল যেন বিনষ্ট না হয়, লোকে যেন তোমাকে কীর্তিনাশা ও কুলনাশক না বলে। পাণ্ডবগণ তোমাকে যুবরাজের পদে এবং ধৃতরাষ্ট্রকে মহারাজের পদে প্রতিষ্ঠিত করবেন, তুমি তাদের অর্ধেক রাজ্য দিয়ে রাজলক্ষ্মী লাভ করো।

ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, বৎস, তুমি কৃষ্ণের কথা শোনো, কুলনাশক কুপুরুষ হয়ো না, হিতৈষীদের উপদেশ অমান্য কোরে কুপথে যেয়ো না, পিতামাতাকে শোকগ্রস্ত কোরো না। দ্রোণ দুর্যোধনকে বললেন, কৃষ্ণ ও ভীষ্ম তোমাকে ধর্মসংগত হিতোপদেশ দিয়েছেন, তুমি এঁদের কথা শোনো, কৃষ্ণের অপমান করো না। আত্মীয়বর্গ ও সমস্ত প্রজার মৃত্যুর কারণ হয়ো না, কৃষ্ণ ও অর্জুন যে পক্ষে আছেন সে পক্ষকে তুমি অজেয় জেনো। বিদুর বললেন, দুর্যোধন, তোমার জন্য শোক করি না, তোমার বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্যই করি। তোমার কর্মের ফলে এঁরা অনাথ ও মিত্রহীন হয়ে যাবেন, কুলনাশক কুপুত্রকে জন্ম দেবার ফলে ভিক্ষুক হবেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, দুর্যোধন, মহাত্মা কৃষ্ণের কথা অতিশয় মঙ্গলজনক। তুমি যদি এঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করো তবে নিশ্চয় পরাভূত হবে। ভীষ্ম ও দ্রোণ বললেন, দুর্যোধন, যুদ্ধ আরম্ভের আগেই শত্রুতার অবসান হোক। তুমি নতমস্তকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করো, তিনি তার হাত তোমার কাঁধে রাখুন, তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিন, ভীম তোমাকে আলিঙ্গন করুন, পাণ্ডব ভাইদের সঙ্গে তোমাকে মিলিত দেখে এই রাজারা সকলে আনন্দিত হবেন।

দুর্যোধন কৃষ্ণকে বললেন, তুমি বিবেচনা না কোরে কেবল পাণ্ডবদের প্রতি প্রীতির বশে আমাকে নিন্দা করছ। তুমি, বিদুর, পিতা, পিতামহ ও আচার্য দ্রোণ, তোমরা কেবল আমাকেই দোষ দাও, পাণ্ডবদের দোষ দেখ না। বিশেষ চিন্তা করেও আমি নিজের বড় বা ছোট কোনও অপরাধই দেখতে পাই না। পাণ্ডবগণ পাশা খেলা ভালবাসেন বলেই আমাদের সভায় এসেছিলেন। সেখানে শকুনি তাদের রাজ্য জয় করেছিলেন তাতে আমার কি দোষ? বিজিত ধন পিতার আজ্ঞায় তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার পর তারা আবার পরাজিত হয়ে বনে গিয়েছিলেন, তাতেও আমাদের অপরাধ হয়নি। তবে কি জন্য তারা কৌরবদের শত্ৰুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমাদের বিনষ্ট করতে চান? কোনো কঠোর কথায় ভয় পেয়ে আমরা ইন্দ্রের কাছেও নত হবে না। পাণ্ডবদের কথা দূরে থাক, দেবতারাও ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণকে পরাস্ত করতে পারেন না। আমরা শত্রুর নিকট নত না হয়ে যদি যুদ্ধে বীরশয্যা লাভ করি তবে বন্ধুগণ আমাদের জন্য শোক করবেন না। কৃষ্ণ, আগে আমার পিতা পাণ্ডবগণকে যে রাজ্যের অংশ দেবার আদেশ দিয়েছিলেন, আমি জীবিত থাকতে পাণ্ডবরা তা পাবেন না। যখন আমি অল্পবয়স্ক ও পরাধীন ছিলাম, তখন না বুঝে বা ভয়ের বশে পিতা যা দিতে চেয়েছিলেন এখন তা আমি দেবো না। তীক্ষ্ম সূচীর অগ্রভাগ যে পরিমাণ ভূমি স্পর্শ করে, তাও আমি পাণ্ডবগণকে দেবো না।

ক্রোধ সংবরণ কোরে হাসতে হাসতে কৃষ্ণ বললেন, তুমি আর তোমার মন্ত্রীরা যুদ্ধে বীরশয্যাই লাভ করবে। পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে তুমি শকুনির সঙ্গে পাশা খেলার আয়োজন করেছিলে। তুমি ভিন্ন আর কে ভাইয়ের স্ত্রীকে সভায় আনিয়ে নির্যাতন করতে পারে? তুমি, কর্ণ আর দুঃশাসন অনার্যের ন্যায় বহু নিষ্ঠুর কথা বলেছিলে। বারণাবতে পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীকে তুমি পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিলে। সব সময় তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে এইরূপ ব্যবহার কোরে আসছ, তবে তুমি অপরাধী নও কেন? তারা তাদের পৈতৃক অংশই চাইছেন, তাতেও তুমি সম্মত নও। পাপাত্মা, ঐশ্বর্যহীন হয়ে ও মৃত্যুবরণ কোরে তোমাকে অবশেষে সবই দান করতে হবে।

দুঃশাসন দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, আপনি যদি সন্ধি না করেন, তবে ভীষ্ম, দ্রোণ ও পিতা আপনাকে, আমাকে ও কর্ণকে বন্দী কোরে পাণ্ডবদের হাতে দেবেন। এই কথা শুনে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে বিশাল সাপের মতো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সভা থেকে উঠে চলে গেলেন আর সেইসঙ্গে তার ভাইয়েরা, মন্ত্রীরা এবং অনুগত রাজারাও তার অনুসরণ করলেন।

ভীষ্ম বললেন, ধর্ম ও অর্থ বিসর্জন দিয়ে যে লোক ক্রোধের বশবর্তী হয়, শীঘ্রই সে বিপদে পড়ে এবং তার শত্রুরা হাসে। কৃষ্ণ বললেন, কুরুবংশের বৃদ্ধগণ মহা অন্যায় করেছেন, একটা মুর্খকে রাজার ক্ষমতা দিয়েছেন অথচ তাকে নিয়ন্ত্রণ করেননি। ভরতবংশীয়গণ, আপনাদের হিতার্থে আমি যা বলছি আশা করি তা আপনারা অনুমোদন করবেন।

দুরাত্মা কংস তার পিতা ভোজরাজ উগ্রসেন জীবিত থাকতেই তার রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। আমি তাকে বধ করে পুনর্বার উগ্রসেনকে রাজপদে বসিয়েছি। কুলরক্ষার জন্য যাদব, বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়গণ কংসকে ত্যাগ করে স্বস্তিলাভ করেছেন। দেবাসুরের যুদ্ধকালে যখন সমস্ত লোক দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে ধ্বংসের মুখে যাচ্ছিল, তখন ব্রহ্মার আদেশে ধর্মদেব দৈত্য ও দানবগণকে বন্দী কোরে বরুণের নিকট সমর্পণ করেছিলেন। আপনারাও দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি আর দুঃশাসনকে বন্দী করে পাণ্ডবদের হাতে দিন। অথবা কেবল দুর্যোধনকেই তাদের হাতে তুলে দিয়ে সন্ধি স্থাপন করুন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আপনার দুর্বলতার জন্য যেন ক্ষত্রিয়গণ বিনষ্ট হন।

______________

(ক্রমশ)